প্রাচীনকালের বাকলা চন্দ্রদ্বীপ নামে খ্যাত ঐতিহাসিক অঞ্চলটি এখন বাংলাদেশের আটটি বিভাগের মধ্যে অন্যতম একটি, যা বর্তমানের বরিশাল বিভাগ। ১৯৯৩ সালে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের ঢাকা বিভাগ ও খুলনা বিভাগের কিছু প্রশাসনিক অঞ্চলের সমন্বয়ে ৬টি জেলা নিয়ে গঠিত হয় বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী বরিশাল বিভাগ। বঙ্গোপসাগরের তীরে অবস্থিত এই বিভাগটি নানান নান্দনিক সৌন্দর্যে ভরপুর। প্রাচীনকালের ঐতিহ্যবাহী বাকলা চন্দ্রদ্বীপ কালীন সময় থেকে ২০ শতক পর্যন্ত এখানে রয়েছে নানান ঐতিহাসিক নিদর্শন। তাছাড়া আধুনিক স্থাপনা, পার্ক ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ঘেরা পর্যটন কেন্দ্রগুলোতো আছেই। ভ্রমণপ্রেমীদের বৈচিত্র্যময় এই বরিশাল বিভাগের সকল জেলার দর্শনীয় স্থানসমূহ সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরা হলো এই লেখাতে।
বরিশাল জেলার দর্শনীয় স্থানসমূহ
ভাসমান পেয়ারা বাজার (Floating Guava Market)
বরিশালের ভাসমান পেয়ারা বাজারটি বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ভাসমান পেয়েরা বাজার। দেশের বরিশাল বিভাগের ঝালকাঠি, পিরোজপুর ও বরিশাল জেলার সীমান্তে গড়ে ঊঠেছে এশিয়া মহাদেশের বৃহত্তম পেয়ারা বাগান। সেই বিস্তৃত বাগানের তিন দিক থেকে আসা খালের মোহনায় ভিমরুলি এলাকায় ভাসমান পেয়ারা বাগান অবস্থিত।
এখানে নৌকায় করে হাজার হাজার কেজি পেয়ারা সাজিয়ে হাট বসে পেয়ারা ব্যবসায়ীদের। মূলত জুলাই-আগস্ট মাস পেয়ারার মৌসুম হলেও, এখানে সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত পেয়ারা বাজার বসে। এছাড়াও পেয়ারা বাজারের পাশে ব্যাকওয়াটারে উপভোগ করতে পারবেন খাকের সাথে লাগানো ঘরবাড়ি, স্থানীয়দের জীবনযাত্রা, স্কুল, ব্রিজ ও রাস্তার সৌন্দর্য।
লাকুটিয়া জমিদার বাড়ি (Lakutia Zamindar Bari)
লাকুটিয়া জমিদার বাড়ি প্রায় ৪০০ বছরের পুরনো একটি ঐতিহাসিক জমিদার বাড়ি। এটি বরিশাল শহর থেকে ৮ কিলোমিটার উত্তরে লাকুটিয়া গ্রামে অবস্থিত। রূপচন্দ্র রায়ের পুত্রয রাজতন্ত্র রায় ইট পাথর আর সূড়কির গাঁথুনিতে এই জমিদার বাড়িটি নির্মাণ করেছিলেন। উনিশ শতক পর্যন্ত এই জমিদার বাড়িটি স্থানীয় অঞ্চলের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রবিন্দু ছিল। দৃষ্টিনন্দন ও কারুকার্যমন্ডিত জমিদার বাড়িতে সুবিশাল দিঘী, মাঠ ও অন্যান্য দর্শনীয় নিদর্শন রয়েছে।
মিয়াবাড়ি জামে মসজিদ (Miyabari Jame Masjid)
মিয়াবাড়ি জামে মসজিদ বরিশালের কড়াপুরে অবস্থিত একটি ঐতিহাসিক স্থাপনা। আনুমানিক ১৮ শতকের দিকে বরিশাল জেলার এই প্রাচীন মসজিদটি নির্মাণ করা হয়েছিল। মসজিদের ছাদে নির্মিত আছে তিনটি সুদৃশ্য গম্বুজ। মসজিদের সামনে এবং পেছনে রয়েছে ৪টি করে মোট ৮টি মিনার। মসজিদের পূর্ব দিকে অবস্থিত রয়েছে একটি বিশালাকার পুকুর, যা মসজিদটির শোভা বর্ধন করছে অনেকাংশেই।
বঙ্গবন্ধু উদ্যান বেলস পার্ক (Bangabandhu Udyan Bells Park)
বঙ্গবন্ধু উদ্যান বেলস পার্ক বরিশাল জেলা সদর থেকে ৪ কিলোমিটার দূরে কীর্তনখোলা নদীর কিনারে অবস্থিত। ঐতিহাসিক তথ্যমতে ১৮৯৬ সালে বরিশালের জেলা ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে এন.ডি.বিটসন বেলস এর আগমন হয়। ব্রিটিশ রাজত্বকালে বেঞ্চের শাসনামলে পঞ্চম জর্জের আগমনকে কেন্দ্র করে বর্তমান বঙ্গবন্ধু উদ্যান বেলস পার্কের স্থানে একটি উদ্যান নির্মাণ করেছিলেন। পরবর্তীতে ১৯৯৬ সালে এই পার্কের নাম পরিবর্তন করে বঙ্গবন্ধু উদ্যান রাখা হয়। সবুজ গাছের সমরোহে ঘেরা ৫৫০ ফুট দৈর্ঘ্য ও ৪৫০ ফুট প্রস্থের এই পার্টিতে খেলার মাঠ, বসার ছাউনি, হ্যালিপ্যাড, ওয়াকওয়ে ও একটি হ্রদ রয়েছে।
গুটিয়া মসজিদ (Gutia Mosque)
ঘটিয়া মসজিদ বরিশাল শহর থেকে ১১ কিলোমিটার দূরে উজিরপুর থানার গুটিয়া ইউনিয়নের চাঙ্গুরিয়া গ্রামে ১৪ একর জমির উপর নির্মিত একটি দর্শনীয় মসজিদ। দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম বৃহত্তম এই জামে মসজিদটির নির্মাণ কাজ শুরু হয় ২০০৩ সালের ১৬ই ডিসেম্বর। গুটিয়া মসজিদটিতে একসাথে ১৫০০ মুসল্লী নামাজ আদায় করতে পারে। মসজিদ কমপ্লেক্সের ভেতরে রয়েছে একটি মসজিদ, ১৯৩ ফুট উঁচু একটি সুদৃশ্য মিনার, ২০ হাজার লোকের ধারণ ক্ষমতা সম্পন্ন ঈদগাহ ময়দান, ফুলের বাগান, এতিমখানা, পুকুর, লেক ইত্যাদি। বিশাল এই মসজিদ প্রাঙ্গণের সৌন্দর্য্য উপভোগ করতে এবং নামাজ আদায় করতে বহু দর্শনার্থীদের আগমন হয় এখানে।
শাপলা গ্রাম (Shapla village)
শাপলা গ্রাম বরিশাল সদর থেকে ৬০ কিলোমিটার দূরে উজিরপুর উপজেলার সাতলা গ্রামে অবস্থিত। বিলের পানিতে ফুটে থাকা হাজারো লাল শাপলার দিগন্ত জোড়া এই বিলকে স্থানীয়রা শাপলা বিল বলে থাকে। প্রায় ১০ হাজার একর জলাভূমিতে বহুকাল পূর্ব থেকে লাল, সাদা ও বেগুনি এই ৩ রঙের শাপলা জন্মায়। ভ্রমণ, পরিদর্শন ও ফটোগ্রাফির জন্য এই শাপলার বিল বা সমগ্র শাপলা গ্রামটি একটি আদর্শ স্থান।
বিবির পুকুর (Bibir Pukur)
বিবির পুকুর বরিশাল শহরের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত একটি ঐতিহ্যবাহী জলাশয়। এর দৈর্ঘ্য প্রায় ১৮৫০ ফুট এবং প্রস্থ প্রায় ৪০০ ফুট। জানা যায়, স্থানীয়দের পানির কষ্ট নিরসনের উদ্দেশ্যে ১৯০৮ সালে জিন্নাত বিবি এখানে এই পুকুরটি খনন করেছিলেন। ঐতিহাসিক এই পুকুরটির সাথে তৎকালীন সময়ে কীর্তনখোলা নদীর মাঝে দুইটি সংযোগ ছিল। ফলে নিয়মিতভাবেই পানির জোয়ার ভাটা দেখা যেত এবং স্থানীয়দের পানির কষ্ট দূর হতো। বর্তমানে এই ঐতিহাসিক পুকুরটি একটি দর্শনীয় স্থানে পরিণত হয়েছে।
পটুয়াখালী জেলার দর্শনীয় স্থানসমূহ
কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকত (Kuakata Beach)
কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকত সূর্যাস্ত ও সূর্যোদয়ের অপূর্ব দৃশ্য উপভোগের জন্য বাংলাদেশের অন্যতম আদর্শ স্থান। সাগরের তীরে প্রাকৃতিক নৈসর্গিক সৌন্দর্যের কারণে এটি সাগর কন্যা নামেও পরিচিত। বাংলাদেশের পটুয়াখালী জেলার কলাপাড়া থানার লতাচাপলি ইউনিয়নে প্রায় ১৮ কিলোমিটার দীর্ঘ এই সমুদ্র সৈকতের অবস্থান। প্রাকৃতিক ভাবে আকর্ষণীয় সমুদ্র সৈকত পরিচ্ছন্ন বেলাভূমি দিগন্ত জোড়া সুনীল আকাশ এবং ম্যানগ্রোভ বন এই সমুদ্র সৈকতের সৌন্দর্যে আলাদা মাত্রা যুক্ত করেছে।
ফাতরার চর (Fatrar char)
ফাতরার চর পটুয়াখালী জেলাধীন সুন্দরবনের বর্ধিত অংশ হিসেবে কুয়াকাটার পশ্চিম দিকে প্রায় ৯ লক্ষ ৯৭ হাজার ৫০৭ একর জায়গা জুড়ে বিস্তৃত। ঘন সবুজ অরণ্যে ঢাকা এই চরটিতে স্থায়ীভাবে মানুষের বসবাস নেই। তবে এই চরে থাকা পুকুর মানুষের মিঠা পানির চাহিদা পূরণ করে। এখানে রয়েছে একটি ছোট ও আকর্ষণীয় সমুদ্র সৈকত। ফাতরার চরে সুন্দরী গাওয়া, কেওড়া, ফাতরা, গড়ান, গোলপাতা, বাইন ইত্যাদি ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চলের অসংখ্য উদ্ভিদ এবং বানর শূকর ইত্যাদি পশুপাখি থাকায়, এটিকে দ্বিতীয় সুন্দরবনও বলা হয়।
সোনারচর (Sonarchar)
সোনারচর হলো পটুয়াখালী জেলার গলাচিপা উপজেলা থেকে ৮০ কিলোমিটার দূরে বঙ্গোপসাগরে জেগে ওঠা একটি নয়নাভিরাম সমুদ্র সৈকত। সৈকতের সম্পূর্ণটা জুড়ে লাল কাঁকড়াদের অবাধ বিচরণ, চঞ্চল সাগরের উত্তাল ঢেউ, স্থানীয় জেলাদের মাছ ধরার দৃশ্য এবং সমুদ্র সৈকতের জীববৈচিত্র্যপূর্ণ ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল একসাথে দেখতে অসাধারণ। সেখানের যাতায়াত ব্যবস্থা তুলনামূলক দুর্গম এবং বিপদ সংকল হওয়া সত্বেও, প্রকৃতির রূপ অন্বেষণ করতে পর্যটকদের আকর্ষণের কাছে তা হার মেনেছে।
চর বিজয় (Char Bijoy)
চর বিজয় হলো বঙ্গোপসাগরে জেগে ওঠা একটি মনোমুগ্ধকর দ্বীপ। এটি সাগরকন্যা কুয়াকাটার পূর্বে গঙ্গামতী জঙ্গলের দক্ষিণ-পূর্বক ফোনে প্রায় ৪০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে, বিজয়ের মাসে একদল ভ্রমণ পিপাসু অভিযাত্রীর মাধ্যমে এই দ্বীপটির আবিষ্কৃত হওয়ায় একে চর বিজয় নামকরণ করা হয়। এ চরটি প্রায় ৫ হাজার একর জায়গা জুড়ে বিস্তৃত। হাজারো অতিথি পাখিদের বিচরণ হওয়া এই দ্বীপটির চারদিকে কেওড়া ও সুন্দরী গাছসহ গোলপাতা, ছইলা ইত্যাদি ২০০০ ম্যানগ্রোভ প্রজাতির গাছের চারা লাগানো হয়েছে। বৈচিত্র্যময়, নয়নাভিরাম সৌন্দর্য ও বিস্তীর্ণ জলরাশি হাজারো দর্শনার্থীদের আকর্ষণ করে।
মজিদবাড়িয়া শাহী মসজিদ (Majidbaria Shahi Mosque)
মজিদবাড়িয়া শাহী মসজিদ পটুয়াখালী জেলার মির্জাগঞ্জ উপজেলায় প্রায় ৫৫০ বছরের পুরনো তৎকালীন দক্ষিণাঞ্চলের প্রাচীন মুসলিম সুলতানি স্থাপত্য শৈলীর এক অন্যতম নিদর্শন। মসজিদের শিলালিপি থেকে জানা যায়, ১৪৬৫ সালে ইলিয়াস শাহী বংশের নবাব রুকনুদ্দিন বরবকের খান-ই-মোয়াজ্জেম উজিয়াল খান এই মসজিদটি নির্মাণ করেছিলেন। ৪৯ ফুট দৈর্ঘ্য এবং ৩৫ ফুট প্রস্থ বিশিষ্ট এই মসজিদের তিনটি দৃষ্টিনন্দন কারুকার্য-খচিত মেহরাব, তিনটে খিলান পথ রয়েছে। এই মসজিদের দেয়ালগুলো প্রায় ৭৫ ইঞ্চি পুরুত্ব বিশিষ্ট।
লেবুর চর (Lebur Char)
লেবুর চর পটুয়াখালী জেলার কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকত থেকে ৫ কিলোমিটার পূর্বে প্রায় ১ হাজার একর জায়গা জুড়ে বিস্তৃত একটি চর। অতীতে এটি সুন্দরবনের অংশ হিসেবে বিবেচিত হতো। তবে এখন তা বিচ্ছিন্ন হলেও এই চরের শেষপ্রান্তে দাড়ালে সুন্দরবনের সবুজ গাছের সারি দেখা যায়। বিশালাকার এই চরে কেওড়া, গোরান, গেওয়া, কড়ই, গোলপাতা সহ বহু প্রজাতির গাছপালা রয়েছে। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যবেষ্টিত এই লেবুর চর এখন পর্যটকদের জন্য আকর্ষনীয় স্থান।
ভোলা জেলার দর্শনীয় স্থানসমূহ
জ্যাকব টাওয়ার (Jacob Tower)
জ্যাকব টাওয়ার হলো ২২৫ ফুট উচ্চতার একটি ওয়াচ টাওয়ার। বাংলাদেশের ভোলা জেলার চরফ্যাশন এলাকায় দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সর্বোচ্চ উচ্চতার এবং আকর্ষণীয় এই ওয়াচ টাওয়ারটি অবস্থিত। এটি আইফেল টাওয়ারের আদলে নির্মিত। সম্পূর্ণ স্টিলের কাঠামো তৈরি হওয়ায় এই টাওয়ারটি ৮ মাত্রার ভূমিকম্প সহনশীল। টাওয়ারের প্রতি তলায় ৫০ জন এবং পুরো টাওয়ারে ৫০০ জন দর্শনার্থী অবস্থান করতে পারে। উপরে ওঠার জন্য সিঁড়ির পাশাপাশি রয়েছে ১৬ জন ধারণক্ষমতা সম্পন্ন স্বচ্ছ গ্লাসের ক্যাপসুল লিফট। এই টাওয়ারের উপর থেকে প্রায় ১০০ কিলোমিটার পর্যন্ত চারিদিকের সৌন্দর্য উপভোগ করা যায়।
স্বাধীনতা জাদুঘর (Independence Museum)
স্বাধীনতা জাদুঘর ভোলা জেলার বাংলাবাজার এলাকায় অবস্থিত। মূলত তরুণ প্রজন্মকে স্বাধীনতার যুদ্ধের সঠিক ইতিহাস সম্পর্কে অবগত করতে প্রায় এক একর জায়গার উপর এই জাদুঘরটি নির্মাণ করা হয়েছে। স্বাধীনতা যুদ্ধে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের সম্পূর্ণ ইতিহাস সংরক্ষিত আছে।
এই জাদুঘরের প্রথম তলায় বঙ্গভঙ্গ, ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন, দেশ বিভাজন এবং ৫২ এর ভাষা আন্দোলনের ঐতিহাসিক ঘটনার ধারাবাহিক ইতিহাস রয়েছে। দ্বিতীয় তলায় ১৯৫২ থেকে ১৯৭১ এর ১৬ই ডিসেম্বর এবং তৃতীয় তলায় স্বাধীনতা পরবর্তী আন্দোলন সংগ্রামের ইতিহাসের তথ্যাদি রয়েছে।
তারুয়া সমুদ্র সৈকত (Tarua Beach)
তারুয়া সমুদ্র সৈকত ভোলা জেলার চরফ্যাশন উপজেলার দক্ষিণ প্রান্তের ঢালচরে অবস্থিত। এই সমুদ্র সৈকতটি প্রায় ৭ কিলোমিটার দীর্ঘ। সমুদ্র সৈকতের এক পাশে রয়েছে বিস্তীর্ণ চারণ ভূমি এবং অন্য পাশে বঙ্গোপসাগর। চারপাশের নির্জন পরিবেশ, সমুদ্রের উত্তাল ঢেউ এবং অপার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য সকল দর্শনার্থীদেরই বিশেষভাবে উদ্দীপনা যোগায়। জীববৈচিত্রের মধ্যে এখানে হরিণ, বানর, বন্য মহিষ, লাল কাঁকড়াসহ বৈচিত্রময় প্রাণীর বসবাস দেখা যায়।
মনপুরা দ্বীপ (Manpura Island)
মনপুরা দ্বীপ বাংলাদেশের ভোলা জেলার অন্তর্গত একটি বিচ্ছিন্ন দ্বীপ এবং একটি ভিন্নরকম প্রাকৃতিক বৈচিত্র্য কেন্দ্র। এই দ্বীপটিতে হরিণের অভয়াস্রম মনপুরা ল্যান্ডিং স্টেশন এবং চৌধুরী প্রজেক্ট, দীপ থেকে সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত দেখার বিরল সুযোগ বিশাল এলাকা জুড়ে বিস্তৃত পুকুর ও লেকের পার্ক এসে সারি সারি নারিকেল গাছ ইত্যাদি সৌন্দর্য উপভোগ করা যায়। এই দ্বীপের পূর্ব, পশ্চিম এবং উত্তর দিকে মেঘনা নদী দ্বারা বেষ্টিত এবং দক্ষিণে রয়েছে বঙ্গোপসাগর। সাইক্লিন এবং ক্যাম্পিং করার জন্য এটি একটি আদর্শ স্থান।
চর কুকরি মুকরি (Char kukri mukri)
চর কুকরি মুকরি হলো বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ বন্যপ্রাণীর অভয়ারণ্য। এটি ভোলা শহর থেকে প্রায় ১২০ কিলোমিটার দূরে বঙ্গোপসাগরের কোল ঘেঁষে মেঘনা নদীর মোহনায় অবস্থিত। চর কুকরি মুকরি সুন্দরী, কেওড়া, নারকেল, গাওয়া, পশুর, বাঁশ ও বেত ইত্যাদি গাছপালায় ভরপুর। এই চড়ে বনভূমির পরিমাণ প্রায় ৮৫৬৫ হেক্টর এবং প্রায় ২১৭ হেক্টর জমি বন্যপ্রাণীর অভয়াশ্রম হিসেবে ব্যবহৃত হয়। অভয়াশ্রমে চিত্রা হরিণের পাশাপাশি বিভিন্ন বন্যপ্রাণীর দেখা মিলে।
বরগুনা জেলার দর্শনীয় স্থানসমূহ
লালদিয়া বন ও সমুদ্র সৈকত (Laldia forest and beach)
লালদিয়া বন ও সমুদ্র সৈকত বরগুনা জেলার পাথরঘাটা উপজেলার দক্ষিণ দিকে অবস্থিত। এই বনের পূর্ব দিকে বিশখালী এবং পশ্চিম দিকে বলেশ্বর নদী প্রবাহিত হয়েছে। সামনেই রয়েছে সাগরের মোহনা এবং বনের পূর্ব প্রান্তে সমুদ্র সৈকত। এই সমুদ্র সৈকতের আয়তন তুলনামূলক ছোট হলেও এর সৌন্দর্য অত্যন্ত আকর্ষণীয়। লাল দিয়ে সমুদ্র সৈকতের কাছাকাছি থাকা শুটকি পল্লীতে দীর্ঘ ৫০ বছরের বেশি সময়ে যাবত শুটকি উৎপাদনের ঐতিহ্যও রয়েছে।
টেংরাগিরি ইকো পার্ক (Tengragiri Eco Park)
টেংরাগিরি ইকো পার্ক বরগুনা জেলার তালতলী উপজেলা থেকে ২৪ কিলোমিটার দূরে সোনাকাটা ইউনিয়নে অবস্থিত। সুন্দরবনের একাংশের বিশাল বনভূমি নিয়ে এই বন্যপ্রাণীর অভয়ারণ্যটি গড়ে তোলা হয়েছে। এই টেংরাগিরি বন প্রায় চার হাজার আটচল্লিশ হেক্টর জায়গা জুড়ে পূর্ব পশ্চিমে ৯ কিলোমিটার ও উত্তর দক্ষিণে ৪ কিলোমিটার পর্যন্ত বিস্তৃত। ২০১১-১২ অর্থবছরে বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয় এই টেংরাগিরি বনাঞ্চলে সোনাকাটা ইকোপার্ক পর্যটন কেন্দ্রটি গড়ে তুলেছিল। এই বনটি বিভিন্ন প্রজাতির বন্যপ্রাণীর বাসস্থান।
বিবি চিনি শাহী মসজিদ (Bibi Chini Shahi Masjid)
বিবি চিনি শাহী মসজিদ বরগুনা জেলার বেতাগী উপজেলার বিবিচিনি ইউনিয়নের ছোট্ট টিলার উপর নির্মিত একটি ঐতিহাসিক মসজিদ। ঐতিহাসিক তথ্যমতে, ১৬৬৯ সালে হযরত শাহ নেয়ামত উল্লাহ (রঃ) পারস্য থেকে ইসলাম প্রচারের জন্য এই অঞ্চলে আগমন করেছিলেন। তখন তিনি এই মসজিদটি নির্মাণ করে নিজের কন্যা সন্তানের নামানুসারে মসজিদে নাম রাখেন। ঐতিহাসিক এই মসজিদটির দৈর্ঘ্য ও প্রস্থ ৩৩ ফুট এবং দেয়ালগুলো ৬ ফুট চওড়া।
হরিণঘাটা পর্যটন কেন্দ্র (Haringhata Tourist Center)
হরিণঘাটা পর্যটন কেন্দ্রটি মূলত সুন্দরবনের এই একটি অংশ। এটি বরগুনা জেলার দক্ষিণ প্রান্তে অবস্থিত। জানা-অজানা বিভিন্ন গাছ পালার প্রাকৃতিক বন, সাগরের হাতছানিতে মুগ্ধতা এবং বন্যপ্রাণীর এই বিচরণস্থলটি সবমিলিয়ে ভ্রমণের জন্য অন্যতম আকর্ষণীয় স্থান। সবুজ বনের ভেতর দিয়ে পাকা রাস্তা, সামনে নদী এবং সেখানে নৌকায় করে ভ্রমণের সুযোগ ইত্যাদি মনোরম পরিবেশ বহু দর্শনার্থীদের আকর্ষণ করে। এখানে হরিণ, বানর, শূকর সহ অন্যান্য বন্য প্রাণীর আবাস রয়েছে।
ঝালকাঠি জেলার দর্শনীয় স্থানসমূহ
সুজাবাদ কেল্লা (Sujabad Fort)
সুজাবাদ কেল্লা বাংলার সুবিধার মোঘল সম্রাট শাহজাহানের পুত্র শাহজাদা সুজার নির্মাণ করা একটি কেল্লা। এটি ঝালকাঠি জেলার নলছিটি উপজেলার মগর ইউনিয়নের সুজাবাদ গ্রামে অবস্থিত একটি ঐতিহাসিক স্থাপনা। প্রায় ১৬৫৪ সালে বাংলার সুবেদার পুত্র শাহজাদা সুজা জলদস্যুদের শায়েস্তা করার উদ্দেশ্যে এই কেল্লা নির্মাণ করেছিলেন। বর্তমানে এই কেল্লাটি স্থানীয়দের মাঝে ‘পুরাতন কলেজ’ নামে অধিক পরিচিত।
গাবখান সেতু (Gabkhan Bridge)
গাবখান সেত হলো গাবখান চ্যানেলের উপর প্রতিষ্ঠিত ৫ম বাংলাদেশি চীন মৈত্রী সেতু। গাবখান সেতুটি সন্ধ্যা ও সুগন্ধা নদীর মধ্যে সংযোগ স্থাপন করার জন্য বাংলাদেশের একমাত্র কৃত্রিম নৌপথ। এটি দেশের সর্বোচ্চ উঁচু সেতু হিসেবে স্বীকৃতিপ্রাপ্ত। এই সেতুর নির্মাণশৈলী অন্যান্য সেতুর থেকে ভিন্ন এবং আকর্ষণীয়।
সাতুরিয়া জমিদার বাড়ি (Saturia Zamindar House)
সাতুরিয়া জমিদার বাড়িটি হলো বাংলার বাঘ হিসেবে পরিচিত এ.কে.এম ফজলুল হকের জন্মস্থান। এটি ঝালকাঠি জেলা থেকে ২১ কিলোমিটার দূরে রাজাপুর উপজেলায় অবস্থিত। ঐতিহাসিক তথ্য মতে, ১৭ শতকে ফজলুল হকের মাতামহ ‘শেখ শাহাবুদ্দিন’ সাতুরিয়ায় ১০০ একর জায়গার উপর এই জমিদার বাড়িটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। ঐতিহাসিক বহু উজ্জ্বল নিদর্শন বহনকারী এই জমিদার বাড়িটির কারুকার্য খচিত নির্মাণশৈলী ফুলের বাগান, পুকুর, মুঘল আমলের ভবন ইত্যাদি এখানের অন্যতম আকর্ষণীয় নিদর্শন।
কীর্তিপাশা জমিদার বাড়ি (Kirtipasha Zamindar House)
কৃত্তিপাশা জমিদার বাড়ি ঝালকাঠি জেলা শহর থেকে ৫ কিলোমিটার দূরে রাজাপুর উপজেলার কীর্তিপাশা ইউনিয়নে অবস্থিত। বিক্রমপুর জমিদারের বংশধরের কিছু অংশ ১৯ শতকের শেষের দিকে এই জমিদার বাড়িটি প্রতিষ্ঠা করেছিল। বর্তমানে এই জমিদার বাড়ির একটি অংশ জুড়ে রয়েছে প্রসন্ন কুমার মাধ্যমিক বিদ্যালয়। এবং কমলিকান্ত নবীনচন্দ্র বালিকা মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও রয়েছে এই জমিদার বাড়ির নাট্যমঞ্চ ও হলরুমকে ঘিরে। এখানে ঐতিহাসিক নানান স্মৃতি জড়িত রয়েছে।
পিরোজপুর জেলার দর্শনীয় স্থানসমূহ
ভান্ডারিয়া শিশু পার্ক (Bhandaria Children’s Park)
ভান্ডারিয়া শিশু পার্ক পিরোজপুর জেলার ভান্ডারিয়া উপজেলায় অবস্থিত একটি পারিবারিক বিনোদন কেন্দ্র। এই পার্কটি পায় ৩.৩৮ একর জায়গা জুড়ে স্থাপিত। এখানে বিভিন্ন প্রজাতির অসংখ্য গাছপালা ও ফুলের বাগান, বিভিন্ন ধরনের আকর্ষণীয় রাইড এবং বিভিন্ন প্রাণীর প্রতিকৃতি রয়েছে। পিরোজপুর জেলার দূরদূরান্তের সকল বয়সী দর্শনার্থীদের জন্য এটি উপযুক্ত বিনোদন কেন্দ্র।
হরিণপালা রিভার ভিউ ইকো পার্ক (Harinpala River View Eco Park)
হরিণপালা রিভার ভিউ ইকো পার্ক পিরোজপুর জেলার ভান্ডারিয়া উপজেলার তেলিখালি ইউনিয়নে কঁচা নদীর তীরে অবস্থিত। ২০১৪ সালে প্রায় ছয় একর জায়গার উপর এই পার্কটি গড়ে তোলা হয়েছে। এই পার্কের পাশেই প্রায় ৭৪ এখন জায়গাজুড়ে রয়েছে হরিণ ও পাখির অভয়ারণ্য। হরিণপালা রিভার ভিউ ইকো পার্কের মধ্যে রয়েছে নান্দনিক ফোয়ারা, ওয়াচ টাওয়ার, পশুপাখির প্রতিকৃতি, ঘোড়ার গাড়ি, টয় ট্রেন এবং বিভিন্ন আকর্ষণীয় রাইট। নদীর ঢেউ, কাশবন ও পাখির কলকাকলিতে মুখরিত থাকা এই পার্কের সুবিশাল পুকুরে নৌকায় চড়া, বাংলা ও চাইনিজ খাবারের রেস্টুরেন্ট এবং পার্কে রাত্রিযাপন করারও ব্যবস্থা রয়েছে।
রায়েরকাঠী জমিদার বাড়ি (Rayerkathi Zamindar House)
রায়েরকাঠী জমিদার বাড়িটি পিরোজপুর জেলা সদর থেকে মাত্র ৩ কিলোমিটার উত্তরে অবস্থিত প্রায় ৩৫০ বছরের পুরনো একটি ঐতিহাসিক স্থাপনা। এই জমিদার বাড়িতে প্রায় ২০০টি অট্টালিকা ছিলো। তন্মধ্যে ৪০-৫০ টি বিশালাকৃতির অট্টালিকা শুধুমাত্র রাজবাড়ীর শোভা বর্ধনের জন্যই নির্মিত হয়েছিল। এখানে ঐতিহাসিক নিদর্শন এর মধ্যে রয়েছে রাজভবন, নহবৎ খানা, নাট্যশালা, অতিথিশালা ও অন্যান্য স্থাপনা।
ডিসি পার্ক (DC Park)
ডিসি পার্ক পিরোজপুর জেলা সদরের নামাজপুর গ্রামের বলেশ্বর নদীর তীরে অবস্থিত একটি ঐতিহ্যবাহী স্থান। স্থানীয়দের কাছে এটি ‘পিরোজপুর রিভার ভিউ ইকো পার্ক’ নামেও পরিচিত। ২০০৭ সালে পিরোজপুর জেলার সাবেক জেলা প্রশাসক এই পার্ক স্থাপন শুরু করায় এটি ভিসি পার্ক নামে পরিচিত।
এই পার্কটিতে রয়েছে ফোয়ারা, সুদৃশ্য লেক, দুটি কাঠের সেতু, কফি হাউজ, প্যাডেল বোটের ব্যবস্থা, ফুলের বাগান, দোলনা, বসার বেঞ্চ, গোল ছাতা, কটেজ ইত্যাদি। এই পার্কের অন্যতম আকর্ষণ হল নদীর পাড় ঘেঁষে নির্মিত রাস্তা এবং ৫ তলা উচ্চতার একটি ওয়াচ টাওয়ার। ওয়াচ টাওয়ার থেকে উপভোগ করতে পারবেন চারপাশের মনোমুগ্ধকর পরিবেশ।
শেষকথা
উপরোক্ত বরিশাল বিভাগের সকল জেলার দর্শনীয় স্থানসমূহ থেকে প্রতিটি দর্শনীয় স্থান আপনাকে ভিন্নধর্মী ভ্রমণের স্বাদ দিবে। তবে এই সকল স্থানে ভ্রমণের পূর্বে সেখানের প্রশাসনিক ব্যবস্থা, নিরাপত্তাজনিত বিষয়াবলী এবং ভ্রমণ সুবিধা সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে নিন।