বাংলাদেশের সকল জেলাগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি দর্শনীয় স্থান ও পর্যটন আকর্ষণে ভরপুর ভারতীয় সীমান্তবর্তী এলাকায় অবস্থিত রয়েছে সিলেট বিভাগ। ১৯৯৫ সালে ১ আগস্ট সিলেট, মৌলভীবাজার, সুনামগঞ্জ ও হবিগঞ্জ এই ৪টি জেলা নিয়ে বাংলাদেশের ৬ষ্ঠ বিভাগ হিসেবে সিলেট বিভাগ গঠিত হয়েছে। পাহাড়ি অঞ্চল, ঝর্ণাধারা, পাহাড়ি নদী, বনভূমি, লেক, হাওর, বৃষ্টি ভেজা আবহাওয়া, আধুনিক ও প্রাকৃতিক বিনোদন কেন্দ্র, জাতীয় উদ্যান, পিকনিক স্পট, রিসোর্ট ইত্যাদি সকল প্রকার পর্যটন আকর্ষণে ভরপুর এই বিভাগটি। তাই ভ্রমণপিপাসুদের জন্য, সিলেট বিভাগের সকল জেলার দর্শনীয় স্থানসমূহ সম্পর্কে দর্শনীয় বিষয়বস্তু এবং পর্যটন আকর্ষণ গুলোর তথ্য তুলে ধরা হলো এই লেখাতে।
সিলেট জেলার দর্শনীয় স্থানসমূহ
জাফলং (Jaflong)
জাফলং সিলেট জেলা সদর থেকে সড়ক পথে ৫৬ কিলোমিটার দূরে গোয়াইনঘাট উপজেলায় বাংলাদেশের সিলেটের সীমান্তবর্তী এলাকায় অবস্থিত। বাংলাদেশের প্রকৃতি কন্যা জাফলং সত্যিই এক অসম্ভব সুন্দর দর্শনীয় স্থান।
সীমান্তের ওপারে ইন্ডিয়ান পাহাড় টিলা, ডাউকি পাহাড় থেকে অবিরাম প্রবাহমান জলপ্রপাত, ঝুলন্ত ডাউকি ব্রীজ, পিয়াইন নদীর স্বচ্ছ হীম ঠান্ডা পানি,উঁচু পাহাড় গুলোতে গহিন অরণ্য এবং নিরবতা সত্যিই আশ্চর্যকর এবং মনোমুগ্ধকর। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, স্বচ্ছ নদী, অনন্য পাথর, বিস্তীর্ণ চা বাগান, চুনাপাথর খনি এবং স্থানীয় সংস্কৃতি, খাবার, হস্তশিল্প ইত্যাদি একজন জাফলং ভ্রমণ কারীকে বিমোহিত করে।
ভোলাগঞ্জ সাদা পাথর (Bholaganj white stone)
ভোলাগঞ্জ বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত বাংলাদেশের সর্ববৃহত্তম পাথর কোয়ারির অঞ্চল। প্রায় ১১ কিলোমিটার এলাকা নিয়ে ভোলাগঞ্জ রোপওয়ে বা রজ্জুপথ দাঁড়িয়ে আছে। উচ্চমানের শ্বেতপাথর উৎপাদনের জন্য বিখ্যাত ভোলাগঞ্জের শ্বেতপাথরের সৌন্দর্য নিহিত রয়েছে এর বিশুদ্ধতা ও অনন্য গঠনের মধ্যে।
বর্তমানে ভোলাগঞ্জ সাদাপাথর উৎপাদন, স্থাপত্য নকশা তৈরি, প্রাচীর ক্ল্যাডিং এবং কাউন্টারটপের মতো অলংকারিক নকশার বাহার দেখতে অনেকে যায় সেখানে। এছাড়াও রয়েছে প্রকৃতি প্রেমীদের জন্য সেরা প্রাকৃতিক সৌন্দর্য।
রাতারগুল (Ratargul)
রাতারগুল সিলেট জেলা শহর থেকে ২৬ কিলোমিটার দূরে গোয়াইনঘাট উপজেলায় অবস্থিত বাংলাদেশের একমাত্র সোয়াম্প ফরেস্ট। সিলেট বিভাগে অবস্থিত এই মিঠা পানির জলাভূমিটি প্রায় ৩০,৩২৫ একর জায়গা জুড়ে বিস্তৃত। এটি একটি অনন্য প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের স্থান, যা পর্যটকদের বিস্মিত করে তোলে। রাতারগুলের সৌন্দর্য নিহিত তার সবুজ, স্বচ্ছ পানি এবং সমৃদ্ধ জীববৈচিত্র্যে।
রাতারগুলের বনটি উচু উচু গাছে ভরা, যার মধ্যে কিছু কিছু ১০০ বছরেরও বেশি পুরনো। সকল গাছগুলো মিলে তৈরি করে একটি ঘন ছাউনি যা বিভিন্ন ছোট উদ্ভিদ ও প্রাণী জাতিকে ছায়া ও আশ্রয় প্রদান করে। বনের জলাশয়ের পানি খুবই স্বচ্ছ এবং সবুজ। এখানে বিভিন্ন প্রজাতির পাখি, সরীসৃপ, মাছ, স্তন্যপায়ী প্রাণীসহ বিভিন্ন ধরণের বন্যপ্রাণীর আবাসস্থল।
তামাবিল (Tamabil)
তামাবিল সিলেটের জেলা শহর থেকে প্রায় ৫৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত সবুজ পাহাড় আর টিলায় ঘেরা এক অনন্য প্রাকৃতিক রূপের অংশ। এটি বাংলাদেশ ও ভারতের সীমান্তে অবস্থিত। এর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, নির্মল পরিবেশ এবং সংস্কৃতি খুবই জনপ্রিয়। তামাবিলের অন্যতম আকর্ষণ হলো তামাবিল-জাফলং সড়ক। জাফলং ভ্রমণ করে তামাবিল যেতে রাস্তার পাশেই রয়েছে পাহাড়, সবুজ চা বাগান এবং একটি প্রবাহিত নদীর শ্বাসরুদ্ধকর দৃশ্য। তামাবিলে পৌছানোর পূর্বেই গাড়িতে ভ্রমণের সময় এলাকার মুগ্ধকরা প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারেন।
এটি বিখ্যাত খাসিয়া উপজাতির আবাসস্থল। খাসিয়া উপজাতিরা তাদের অনন্য জীবনধারা এবং ঐতিহ্যের জন্য পরিচিত। পর্যটকরা সেখানে তাদের ঐতিহ্যবাহী জীবনধারার অভিজ্ঞতা লাভ করতে পারে এবং তাদের সাথে কথা বলে মাধ্যমে তাদের সংস্কৃতি সম্পর্কে জানতে পারেন সহজেই।
বিছনাকান্দি (Bisnakandi)
বিছনাকান্দি সিলেটের গোয়াইনঘাট উপজেলার রুস্তমপুর ইউনিয়নে দেখছি তো জাফলং ও ভোলাগঞ্জের মতোই একটি পাথর কোয়ারি। মূলত পাথরের উপর দিয়ে বয়ে চলা স্বচ্ছ জলধারা আর পাহাড়ে পাহাড়ে শুভ্র মেঘের উড়াউড়িই হলো বিছনাকান্দির প্রধান আকর্ষণ।
এখানে বাংলাদেশ-ভারতের সীমান্তবর্তী খাসিয়া পাহাড়ের বহু ধাপ মিলিত হয়েছে। প্রাকৃতিকভাবে প্রশান্তিময় এই স্থানটি যেন পাথর, পাহাড়, ঝর্ণা আর নদীর সমন্বয়ে গড়ে উঠা একটি প্রাকৃতিক মায়াজাল।
লাক্কাতুরা চা বাগান (Lakkatura Tea Garden)
লাক্কাতুরা চা বাগান সিলেট শহরের চৌকিঢেঁকি উপজেলায় ওসমানি বিমান বন্দরের নিকটে অবস্থিত অনন্য প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ঘেরা চা বাগান। ১৮৪৯ সালে ইংরেজ সাহেব হার্ডসনের হাত ধরে এই চা বাগানটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। মূলত এই চা বাগান থেকেই সিলেটে চা চাষের গোড়াপত্তন হয়। এটি ন্যাশনাল টি বোর্ড অধীনস্থ সরকারি একটি বাগান। এটি বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ একটি চা বাগান। এই চা বাগান থেকে প্রতি বছর প্রায় ৫ লক্ষ কেজি চা উৎপাদিত হয়। এই চা বাগানটি প্রায় ১২৯৩ হেক্টর বা প্রায় ৩২০০ একর জায়গাজুড়ে বিস্তৃত।
বাগানের ভিতর দিয়ে হাঁটলেই চোখে পড়বে কমলা, কাঁঠাল ও সুপারি বাগান। এছাড়াও সেখানে রয়েছে আগর, রাবার, ট্যাং ফল, চন্দনসহ অনেক শোভাবর্ধক বৃক্ষ।
পান্থুমাই ঝর্ণা (Panthumai Jharna)
পান্থমাই ঝর্ণা ভারতের মেঘালয় রাজ্যে সিলেট জেলার গোয়াইনঘাট উপজেলার পশ্চিম জাফলং ইউনিয়নের একটি গ্রাম। এটি বাংলাদেশের সবচেয়ে সুন্দর গ্রাম গুলোর মধ্যে একটি। গ্রামটির পাশেই রয়েছে ঝর্ণা এবং গ্রামের নামেই এর নামকরণ করা হয়েছে পান্থুমাই ঝর্ণা।
পান্থুমাই গ্রামের পিছনে মেঘালয় পাহাড় এবং চলমান পিয়াইন নদীর পাড়ে এই ঝর্ণাটি অবস্থিত। সেখানকার স্থানীয়দের কাছে পান্থুমাই গ্রামের ঝর্ণাটি বিভিন্ন নামে পরিচিত। বিশাল এই ঝর্ণার স্থানীয় নাম গুলো হলো পান্থুমাই ঝর্ণা, ফাটাছড়ির ঝর্ণা, বড়হিল ঝর্ণা ইত্যাদি। কারো কারো কাছে এই ঝর্ণাটি মায়াবতী ঝর্ণা নামেও পরিচিত। এই ঝর্ণার চারিদিকের নৈসর্গিক রূপ, পাহাড়ি ল্যান্ডস্কেপ এবং বেয়ে পড়া ঝর্ণার সৌন্দর্য যেকোনো দর্শনার্থীর নজর কাড়তে সক্ষম।
লালাখাল (Lalakhal)
লালাখাল সিলেটের বিভাগীয় শহর থেকে ৩৫ কিলোমিটার দূরে জৈন্তাপুর উপজেলায় ভারতের চেরাপুঞ্জি পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত। গভীর নীল পানির এই খাল চেরাপুঞ্জি পাহাড় থেকে উৎপন্ন হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। এই খালের চারপাশের পাহাড় গুলো সবুজ গাছে আচ্ছাদিত, ঘূর্ণায়মান নদী এবং এলাকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এটিকে আকর্ষণীয় করে তুলেছে।
লালাখালের পানি এতটাই স্বচ্ছ যে নদীর তলদেশে থাকা পাথর ও নুড়ি দেখা যায় সহজেই। এছাড়াও সেখানকার পানি শীতল এবং সতেজ, যা সাঁতার কাটা, বোটিং এবং মাছ ধরা উপভোগ করার জন্য একটি আদর্শ জায়গা। নদীর চারপাশের পাহাড় গুলো ঘন বন এবং চা বাগানে আচ্ছাদিত একটি নিবিড়-শান্ত পরিবেশ। এছাড়াও এখানে রয়েছে পাখি, বানর ও হরিনসহ বিভিন্ন বন্যপ্রানীর আবাসস্থল।
জৈন্তাপুর (Jaintapur)
জৈন্তাপুর সিলেট শহর হতে ৪০ কিলোমিটার দূরে জৈন্তা-খাসিয়া পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত। এটি ইতিহাস, সংস্কৃতি এবং প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের একটি ছোট শহর। এই শহরে ১৭ শতকে নির্মীত জৈন্তাপুর রাজবাড়ি সহ বেশ কয়েকটি ঐতিহাসিক স্থান রয়েছে।
এর অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো নৈস্বর্গিক লীলাভূমি এবং প্রাকৃতিক দৃশ্য। এই শহরটি পাহাড়, বন এবং চা বাগান দ্বারা বেষ্টিত। প্রকৃতি প্রেমীদের জন্য একটি নিখুঁত প্রশান্তিদায়ক স্থান। চারিদিকের চোখ মেললেই দেখতে পাওয়া যায় পাহাড়, বিস্তৃত চা বাগান, এবং আদিম জলপ্রপাতের একটি নিখুঁত প্রশান্তিদায়ক স্থান। এছাড়াও এই শহরটি অনেক গুলো জাতিগত সম্প্রদায়ের আবাসস্থল।
সংগ্রামপুঞ্জি ঝর্ণা বা মায়াবী ঝর্ণা (Sangrampunji Jharna)
সংগ্রামপুঞ্জি ঝর্ণা সিলেট শহর থেকে ৬২ কিলোমিটার উত্তর-পূর্ব দিকে, ভারতের মেঘালয় সীমান্ত ঘেঁষে খাসিয়া-জৈন্তা পাহাড়ের পাদদেশে, জাফলং জিরো পয়েন্ট থেকে প্রায় ১ কিলোমিটার পশ্চিমে অবস্থিত। এই অত্যাশ্চর্য জলপ্রপাতকে মায়াবী ঝর্নাও বলা হয়। এটি একটি প্রত্যন্ত এলাকায় অবস্থিত। এর চারপাশে সবুজ বন এবং পাহাড় দ্বারা বেষ্টিত।
এই জলপ্রপাতটি ৩০ ফুটের বেশি উচ্চতাসম্পন্ন এবং এর থেকে স্বচ্ছ পানি নিচের পুলে নেমে আসছে ধারাবাহিকভাবে। এই ঝরনার পানি এতটাই পরিষ্কার যে পানির নিচে পাথর এবং বালি দেখতে পাওয়া যায়। এর আশেপাশের অঞ্চলটিও বিস্তৃত উদ্ভিদ এবং প্রাণীর আবাসস্থল। এছাড়াও এখানে বিভিন্ন প্রজাতির পাখি, বানর এবং অন্যান্য বন্যপ্রাণী দেখা যায়।
এছাড়াও লোভাছড়া, ড্রিমল্যান্ড পার্ক, নাজিমগড় গার্ডেন রিসোর্ট ইত্যাদি দর্শনীয় স্থানগুলো ভ্রমণ করতে পারেন।
সুনামগঞ্জ জেলার দর্শনীয় স্থানসমূহ
লালঘাট ঝর্ণাধারা (Lalghat Fountain)
লালঘাট ঝর্ণাধারা হলো সুনামগঞ্জ জেলা সদর থেকে ৩৫ কিলোমিটার দূরে তাহিরপুর উপজেলায় বাংলাদেশ-ভারত জিরো পয়েন্টের কাছে অবস্থিত একটি দৃষ্টিনন্দন ঝর্ণাধারা। ভারতের মেঘালয় পাহাড়ের বুক চিরে বাংলাদেশের ভূখন্ডে নেমে আসে এই স্বচ্ছ পানির ধারাটি। পাহাড়ের ঢাল বেয়ে নেমে আসা আঁকা-বাঁকা ঝর্ণাধারা গিয়ে মিশেছে হাওরের মিঠাপানির সাথে।
এই ঝর্ণাধারার পূর্ব দিকে রয়েছে হাজং সম্প্রদায়ের প্রায় ১৫০+ বাঙালী পরিবার নিয়ে গড়ে উঠা আদিবাসী পল্লী। স্থানীয় সেই গ্রামের নাম সবুজের পল্লী, যেখানে পাহাড়ি, ফলজ, বনজ ও বিভিন্ন প্রকার ফুল গাছ এবং চুনাপাথরের পাহাড়।
পাগলা বড় জামে মসজিদ (Pagla Boro Jame Masjid)
পাগলা বড় জামে মসজিদ সুনামগঞ্জ জেলার দক্ষিন সুনামগঞ্জ উপজেলার মহাসিং নদীর তীরে পাগলা বাজার নামক এলাকায় অবস্থিত। ঐতিহাসিক তথ্য মতে, ১৯৩১ সালে স্থানীয় ব্যবসায়ী ইয়াসীন মির্জা ভারতীয় দক্ষ স্থপতি মুমিন আস্তাগারের মাধ্যমে এই মসজিদের নির্মান কাজ শুরু করেছিলেন। দুইতলা বিশিষ্ট এই মসজিদটির দৈর্ঘ্য ১৫০ মিটার এবং প্রস্থ ৫০ মিটার। এই মসজিদের উপরে ২৫ ফুট উচ্চতার ৩টি গম্বুজ এবং ৬ সুউচ্চ মিনার রয়েছে।
আরও পড়ুন: রংপুর বিভাগের সকল জেলার দর্শনীয় স্থানসমূহ
বর্তমানে এই মসজিদটির চারদিকে স্থাপিত কারুকার্যখচিত ইতালিয়ান, জার্মানি, ও ইংল্যান্ড থেকে আনা টাইলস এবং মসজিদের নির্মাণশৈলী সত্যিই মনোমুগ্ধকর।
বারেক টিলা (Barek Tila)
বারেক টিলা সুনামগঞ্জ জেলার তাহিরপুর উপজেলার বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে অবস্থিত একটি আদিবাসী এলাকা। সবুজে পরিপূর্ণ এই টিলার মধ্যে বসবাস করে প্রায় ৪০টি আদিবাসী পরিবার। এইটিলার পাশে দিয়েই বয়ে চলেছে ভারতের খাসিয়া পাহাড় থেকে আসা জাদুকাটা নদী। বারেক কিলার উপর থেকে সেই খাসিয়া পাহাড় এবং জাদুকাটা নৈসর্গিক দৃশ্য উপভোগ করা যায়। বর্ষাকালে জাদুকাটা নদী বেয়ে ভারত থেকে প্রচুর পরিমাণে বালু এবং পাথর আছে বাংলাদেশে। তখন স্থানীয়দের পাথর ও বালু তোলার কর্মব্যস্ততা চোখে পড়ার মতো। ক্যাম্পিং করার জন্য এই টিলাটি একটি আদর্শ স্থান। তবে অবশ্যই আদিবাসীদের থেকে নিরাপত্তা বজায় রাখা উচিত।
শিমুল বাগান (Shimul garden)
শিমুল বাগান সুনামগঞ্জ জেলার তাহিরপুর উপজেলার জাদুকাটা নদীর কাছে মানিকগাও গ্রামে প্রায় ১০০ বিঘা জায়গাজুড়ে গড়ে তোলা একটি অপরূপ সৌন্দর্যের স্থান। স্থানীয় ব্যবসায়ী জয়নাল আবেদীন ২০০৩ সালের দিকে এই বাগানটি গড়ে তুলেছিলেন। এখানে প্রায় ৩ হাজার শিমুল গাছ রয়েছে। সারি সারি ভাবে লাগানো এই গাছগুলো বসন্তকালে যেন লাল আগুনের ঝলকানি ছড়ায়। লাল লাল শিমুল ফুলের রক্ত লাল পাপড়িগুলোর সৌন্দর্য এবং পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া রূপবতী জাদুকাটা নদী দর্শনার্থীদের মনে এক অন্যরকম শিহরণ জাগায়।
নীলাদ্রি লেক (Niladri Lake)
নীলাদ্রি লেক হলো সুনামগঞ্জ জেলার তাহিরপুর উপজেলার উত্তর শ্রীপুর ইউনিয়নের টেকেরঘাট গ্রামে অবস্থিত চুনাপাথরের পরিত্যক্ত খনির লাইমস্টোন লেক। এই পর্যটন স্থানটি চমৎকার নীল পানি ছোট-বড় টিলা এবং পাহাড়ের সমন্বয়ে অপার্থিব সৌন্দর্যের অধিকারী হয়ে উঠেছে। প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্যে ঘেরা এই লেকটি শহীদ সিরাজ লেক, টেকেরঘাট পাথর কোয়ারি, বাংলার কাশ্মীর ইত্যাদি বিভিন্ন নামে পরিচিত।
টাঙ্গুয়ার হাওর (Tanguar Haor)
টাঙ্গুয়ার হাওর সুনামগঞ্জ জেলায় অবস্থিত বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম মিঠাপানির জলাভূমি। এটি প্রায় ১০০ বর্গ কিলোমিটার পর্যন্ত বিস্তৃত। শুকনো মৌসুমে এর মোট আয়তন ৬,৯১২ একর এবং বর্ষাকালে এর আয়তন ২০,০০০ একর পর্যন্ত হয়। এই হাওরে ভারতের মেঘালয় থেকে প্রায় ৩০টি ছোট-বড় ঝর্ণা এসে মিসেছে। এখানে প্রায় ১৪০ প্রজাতির মাছ, ১৫০ প্রজাতির বেশি সরীসৃর, ১২ প্রজাতিক ব্যাঙ এবং প্রায় ২৫০ প্রজাতির অতিথি পাখির সমন্বয়ে গড়ে উঠেছে বিশাল জীববৈচিত্র্য।
এই হাওরে প্রায় ৪৬ টি ছোট-বড় দ্বীপের মতো ভাসমান গ্রাম বা দ্বীপ গ্রাম রয়েছে। এটি ১৯৯৯ সালে বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক Ecological Critical Area (ECA) হিসেবে ঘোষিত হয় এবং ২০০০ সালে আন্তর্জাতিকভাবে রামসার সাইট এর তালিকায় স্থান করে নিয়েছে।
মৌলভীবাজার জেলার দর্শনীয় স্থানসমূহ
হাকালুকি হাওর (Hakaluki Haor)
হাকালুকি হাওর বাংলাদেশের সিলেট ও সীমান্তবর্তী মৌলভীবাজার জেলায় অবস্থিত। এটি বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ হাওর এবং এশিয়ার মধ্যে অন্যতম বৃহত্তম মিঠাপানির জলাভূমি। এই হাওরের আয়তন প্রায় ২০,৪০০ হেক্টর। এটি ছোট-বড় ১০টি নদী ও ছোট বড় ২৪০ টি বিল জুড়ে বিস্তৃত জায়গা নিয়ে গঠিত। পাঁচটি উপজেলা ও ১১টি ইউনিয়নে বিশাল এই হাওরের বিস্তৃত রয়েছে।
এই হাওরকে ঘিরে ৫২৬ প্রজাতির উদ্ভিদ রয়েছে, তন্মধ্যে এখন ১২০ প্রজাতির উদ্ভিদ বিলুপ্তপ্রায়। এখানে আরো রয়েছে ৩০৫ প্রজাতির দেশীয় পাখি ও ১১২ প্রজাতির অতিথি পাখি। এছাড়াও ১০৭ প্রজাতির মাছ ও ১৪১ প্রজাতির অন্যান্য বন্যপ্রাণী রয়েছে এই হাওরে।
আদমপুর বন (Adampur Forest)
আদমপুর বন বা আদমপুর বিট হলো মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জে রাজকান্দি সংরক্ষিত বনাঞ্চল। এর আয়তন প্রায় ১৩,০৮০ একর। এই জঙ্গলে বহু উঁচু-নিচু টিলা এবং বিশালাকৃতির গাছের নিচ দিয়ে হাঁটার পথ সত্যিই খুব আকর্ষণীয়। এখানে মেছো বাঘ, মায়া হরিণ, উল্লোক, চশমা হনুমান, মুখপোড়া হনুমান, ভাল্লুক সহ অন্যান্য বন্যপ্রাণী এবং নানারকম পাখি দেখা যায়। তাছাড়া এখানে রয়েছে মুলি, মিটিঙ্গা, ডলু ও রূপাই জাতের বাঁশ।
কুলাউড়া পাহাড় (Kulaura hill)
কুলাউড়া পাহাড়টি বাংলাদেশের মৌলভীবাজার জেলার কুলাউড়া উপজেলার কার্মধা ইউনিয়নের বেগুনছাড়া পুঞ্জিতে অবস্থিত প্রায় ১০৯৮ ফুট উচ্চতাবিশিষ্ট একটি পাহাড়। এই পাহাড়ের প্রায় ৬০% বাংলাদেশের এবং ৪০% ভারতের অংশ। ভারত ও বাংলাদেশ উভয় প্রান্তের বহু মানুষ এই বিশাল পাহাড়টিতে ভ্রমন করতে আসেন।
লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান (Lawachara National Park)
লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ ও শ্রীমঙ্গল উপজেলায় সীমান্তবর্তী এলাকায় অবস্থিত একটি সংরক্ষিত বনাঞ্চল। এটি প্রায় ১,২৫০ হেক্টর জায়গাজুড়ে বিস্তৃত। নান্দনিক বৈচিত্র্যে ভরপুর এই উদ্যানটিতে প্রায় ১৬০ প্রজাতির দুর্লভ উদ্ভিদ, ২০ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী ২৪০ প্রজাতির পাখি ও ৬ প্রজাতির সরীসৃপ রয়েছে।
মাধবপুর লেক (Madhavpur Lake)
মাধবপুর লেক মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ উপজেলার মাধবপুর ইউনিয়নে অবস্থিত একটি কৃত্রিম লেক। ১৯৬৫ সালে চা বাগানের টিলায় বাঁধ দিয়ে পানি জমিয়ে প্রায় ৫০ একর আয়তনের এই লেক তৈরি করা হয়েছিল। এর দৈর্ঘ্য প্রায় ৩ কিলোমিটার এবং প্রস্থ অবস্থান ভেদে ৫০-৩০০ মিটার। এখানে সাদা ও নীল পদ্ম ফুল, শীতকালে অতিথি পাখিদের আগমন এবং পাশেই অপরূপ চা বাগান দেখা যায়।
মাধবকুন্ড জলপ্রপাত (Madhabkunda Falls)
মাধবকুন্ড জলপ্রপাত মৌলভীবাজার জেলার বড়লেখা উপজেলায় অবস্থিত একটি পর্যটন কেন্দ্র। এই জলপ্রপাতটি প্রায় ১৬২ ফুট উচ্চতার। এই মাধবকুণ্ড জলপ্রপাতকে কেন্দ্র করে সরকারি উদ্যোগে বাংলাদেশ পর্যটন কর্পোরেশনের রেস্টহাউজ ও রেস্টুরেন্ট এবং ২৬৭ একর জায়গা নিয়ে মাধবকুণ্ড ইকোপার্ক গড়ে তোলা হয়েছে। আশেপাশের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীকে ঘিরে এখানে বহু বাগান গড়ে উঠেছে।
মৌলভীবাজারের চা বাগান (Tea Garden)
মৌলভীবাজার জেলাটি বাংলাদেশে চা উৎপাদনের জন্য বিখ্যাত একটি জেলা। আর চায়ের রাজধানী বলা যায় এই জেলার শ্রীমঙ্গল। নজরকাড়া সৌন্দর্যের শ্রীমঙ্গলের চা বাগান প্রায় ৪৫০ বর্গ কিলোমিটার আয়তনের। উন্নত চা উৎপাদনের জন্য বিশ্বব্যাপী বিখ্যাত এই শ্রীমঙ্গলের চা বাগান যেন পাহাড়ের ঢালে একটি সবুজ গালিচা। বৃহত্তর এই চা বাগান ছাড়াও মৌলভীবাজার জেলায় ৯২ টির মতো চা বাগান রয়েছে।
হাইল হাওর (Hail Hour)
হাইল হাওর মৌলভীবাজার জেলার জেলা সদর, শ্রীমঙ্গল এবং পার্শ্ববর্তী হবিগঞ্জ জেলার বাহুবল উপজেলা জুড়ে বিস্তৃত একটি বিশালাকৃতির জলাভূমি। এই হাওড়ার মোট আয়তন প্রায় ১০ হাজার হেক্টর। ১৪টি বিল ঘেরা এই হাওরে প্রচুর লতা ও গুল্ম জাতীয় উদ্ভিদ থাকার কারণে স্থানীয়ভাবে এটি লতাপাতার হাওর নামেও পরিচিত। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, নীল আকাশ ও পানির মিতালীর পাশাপাশি এখানে রয়েছে প্রায় ৯৮ প্রজাতির মাছ এবং প্রায় ১৬০ প্রজাতির পাখির বিচরণ।
হবিগঞ্জ জেলার দর্শনীয় স্থানসমূহ
সাতছড়ি জাতীয় উদ্যান (Satchari National Park)
সাতছড়ি জাতীয় উদ্যান হবিগঞ্জ জেলার চুনারুঘাট উপজেলায় রঘুনন্দন পাহাড়ে অবস্থিত। ২০০৫ সালে প্রায় ২৪৩ সেক্টর জায়গা নিয়ে এই জাতীয় উদ্যানটি প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। এখানে প্রাকৃতিকভাবে সাতটি পাহাড়ের ঝরনা গড়ে ওঠায় এটি সাতছড়ি নামকরণ করা হয়েছে। এই সাতছড়ি জাতীয় উদ্যানের মধ্যে প্রায় ১৪৫ প্রজাতির গাছপালা, ৬ প্রজাতির উভচর প্রাণী, ২৪ প্রজাতির স্তন্যপায়ী, ১৮ প্রযুক্তির সরীসৃপ এবং প্রায় ১৪৯ প্রজাতির পাখি রয়েছে।
দ্যা প্যালেস লাক্সারি রিসোর্ট (The Palace Luxury Resort)
দ্যা প্যালেস লাক্সারি রিসোর্ট টি হবিগঞ্জ জেলার বাহুবল উপজেলার পুটিজুরী পাহাড়ে অবস্থিত একটি ৫ তারকা মানের রিসোর্ট। সবুজ পাহাড়ের সমাহার আর মেঘের লুকোচুরি খেলায় প্রফুল্ল থাকা এই রিসোর্টটি প্রায় ১৫০ একর পাহাড়ি ভুমিতে গড়ে তোলা হয়েছে।
গ্রীনল্যান্ড পার্ক (Greenland Park)
গ্রীনল্যান্ড পার্ক হবিগঞ্জ জেলার চুনারুঘাট উপজেলার রানীগাঁও ইউনিয়নে অবস্থিত একটি জনপ্রিয় দৃষ্টিনন্দন পারিবারিক বিনোদন কেন্দ্র। বাঁশের তৈরির ঝুলন্ত সাকো, গোল চত্বর, নান্দনিক রেস্টুরেন্ট, লেক, পিকনিক স্পট, নৌকা ভ্রমণ ইত্যাদি আয়োজনে সমৃদ্ধ এই পার্কটি ব্যক্তি মালিকানাধীন।
শংকরপাশা শাহী মসজিদ (Shankar Pasha Shahi Mosque)
শংকরপাশা শাহী মসজিদ হবিগঞ্জ জেলার রাজিউরা ইউনিয়নের অবস্থিত সুলতানি আমলের অন্যতম নিদর্শন। ঐতিহাসিক তথ্য মতে, পঞ্চাদশ শতাব্দীতে তোরা মাটির ইট ব্যবহার করে প্রায় ছয় একর জায়গা জুড়ে একটি টিলার উপর লাল রংয়ের শংকরপাশা শাহী মসজিদ/ লালটিলা মসজিদ নির্মাণ করা হয়েছিল। টেরাকোটার নকশাকৃত চমৎকার নির্মাণশৈলীর এই মসজিদটির বহু সংস্কারের মাধ্যমে বর্তমানে আধুনিকতার রুপ লাভ করেছে।
রেমা-কালেঙ্গা অভয়ারণ্য (Rema-Kalenga Sanctuary)
রেমা-কালেঙ্গা অভয়ারণ্য হবিগঞ্জ জেলার চুনারুঘাট উপজেলায় অবস্থিত প্রায় ১৭৯৫ হেক্টর আয়তনের একটি বনভূমি। বাংলাদেশ বনবিভাগের কালেঙ্গা রেঞ্জের অন্তর্ভুক্ত রেমা, কালেঙ্গা ও ছনবাড়ির বিস্তীর্ণ এলাকা নিয়ে এই অভয়ারণ্যের পরিধি ছড়িয়ে রয়েছে। ১৯৮২ সালে বন্যপ্রাণীর অভয়ারণ্য হিসেবে স্বীকৃতিপ্রাপ্ত এই বনভূমিটি বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম প্রাকৃতিক বনাঞ্চল হিসেবে খ্যাত। এই অভয়াশ্রমে প্রায় ৬৩৮ প্রজাতির গাছপালা, ৬২ প্রজাতির স্তন্যপায়ী, নানান উভচর ও সরীসৃপ প্রাণী এবং প্রায় ১৬৭ প্রজাতির পাখির বিচরণ রয়েছে।
শেষকথা
ভ্রমণ করার জন্য সিলেট বিভাগের সকল জেলার দর্শনীয় স্থানসমূহ হতে পারে আদর্শ। এই বিভাগের জেলার সংখ্যা মাত্র ৪টি হলেও, বাংলাদেশের অন্যান্য সকল বিভাগ গুলোর চেয়ে এর দর্শনীয় স্থান ও পর্যটন কেন্দ্রের সংখ্যা অনেক বেশি। তবে সেই এলাকাগুলোতে উপজাতিদের বসবাস বেশি থাকায় এবং পাহাড়ি অঞ্চল হাওয়ায় নিরাপত্তা বজায় রাখতে হবে।