দোয়া কুনুত ও বিতর নামাজ পড়ার নিয়ম

ইমান আনার পড় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত হলো নামাজ/ সালাত। আর প্রাত্যহিক নামাজের অন্যতম ওয়াজিব হলো বিতর নামাজ। হাদিস শরীফে বিতর নামাজ পড়ার নিয়ম বিভিন্নভাবে উল্লেখিত হয়েছে। সহীহভাবে বিতর নামাজ পড়ার নিয়ম ও বিতর নামাজের দোয়া কুনুত সম্পর্কে বিস্তারিত জানা সকল মুমিন/ মুসলমানদের জন্যই আবশ্যক কর্তব্য।

বিতর নামজকে রাতের সর্বশেষ নামাজও বলা হয়। এশার নামাজের পর থেকে শেষ রাতের আগ পর্যন্ত যে কোনো সময়ে বিতর নামাজ পড়া যায়। এই নামাজের সর্বশেষ রাকাতে মহান আল্লাহ তা’আলার কাছে নিজের চাহিদা ব্যক্ত করে দোয়া কুনুত পড়তে হয় এবং তা অনেক ফজিলতপূর্ন। তাই হাদিসে উল্লেখিত পদ্ধতিতে বিতর নামাজ পড়ার নিয়ম ও দোয়া কুনুত জেনে নিন এখানে।

দোয়া কুনুত বাংলা অর্থসহ

দোয়া কুনুত বিতর নামাজের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ। ‘কুনুত’ শব্দের অর্থ নিরবতা, সালাত, কিয়াম, ইবাদত ইত্যাদি। মানুষ যখন চরম বিপদ ও মুসিবতে পড়ে তখনও এ দোয়া পড়ে আল্লাহর সাহায্য চাওয়া যায়। বিভিন্ন হাদিসে একাধিক দোয়া কুনুত উল্লেখিত রয়েছে। তবে বিখ্যাত সাহাবি হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাঃ) থেকে বর্ণিত একটি আরবি দোয়া কুনুত রয়েছে, যা বহুল প্রচলিত। 

দোয়া কুনুত আরবি 

হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাঃ) থেকে বর্ণিত দোয়া কুনুতটি নিম্নরূপ:

আরবি: اللّهُمَّ إِنَّا نَسْتَعِينُكَ وَنَسْتَغْفِرُكَ وَنُؤْمِنُ بِكَ وَنَتَوَكَّلُ عَلَيْكَ وَنُثْنِيْ عَلَيْكَ الْخَيْرَ وَنَشْكُرُكَ وَلاَ نَكْفُرُكَ، وَنَخْلَعُ وَنَتْرُكُ مَنْ يَّفْجُرُكَ، اللّهُمَّ إِيَّاكَ نَعْبُدُ، وَلَكَ نُصَلِّيْ وَنَسْجُدُ، وَإِلَيْكَ نَسْعٰى وَنَحْفِدُ، نَرْجُو رَحْمَتَكَ وَنَخْشٰى عَذَابَكَ، إِنَّ عَذَابَكَ بِالْكُفَّارِ مُلْحِقٌ

দোয়া কুনুত বাংলা উচ্চারণ

উপরোক্ত বহুল প্রচলিত আরবি দোয়া কুনুতটির বাংলা উচ্চারন নিম্নরূপ:

“আল্লা-হুম্মা ইন্না নাসতা-ঈনুকা, ওয়া নাসতাগফিরুকা, ওয়া নু’মিনুবিকা, ওয়া নাতাওয়াক্কালু আলাইকা, ওয়া নুছনি আলাইকাল খাইর; ওয়া নাশকুরুকা, ওয়া-লা নাকফুরুকা, ওয়া নাখলাঊ, ওয়া নাতরুকু, মাইঁয়্যাফ জুরুকা; আল্লাহুম্মা ইয়্যাকা না’বুদু; ওয়া-লাকা নুসাল্লি, ওয়া নাসঝুদু; ওয়া ইলাইকা নাস’আ ওয়া নাহফিদু; ওয়া নারঝু রাহমাতাকা ওয়া নাখশা আজাবা-কা; ইন্না আজাবাকা বিলকুফফারি মুলহিক্ব।”

দোয়া কুনুতের বাংলা অর্থ

“হে আল্লাহ! আমরা আপনারই সাহায্যপ্রার্থী এবং একমাত্র আপনার কাছেই ক্ষমাপ্রার্থী। আমরা আপনার উপরই ঈমান এনেছি এবং আপনার উপরই ভরসা করি, আপনার উত্তম প্রশংসা করি; আপনার শোকর আদায় করি; আপনার প্রতি অকৃতজ্ঞ হই না; যারা আপনার নাফরমানী করে; তাদেরকে পরিত্যাগ করি এবং তাদের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করি। 

হে আল্লাহ! আমরা আপনার ইবাদাত করি; আপনার জন্যই সালাত আদায় করি এবং আপনাকেই সিজদা করি; আপনার দিকেই ধাবিত হই; আপনার হুকুম পালনের করতেই প্রস্তুত থাকি; আপনার রহমতে কামনা করি; আপনার শাস্তিকে ভয় করি। নিঃসন্দেহে, আপনার শাস্তি ভোগ করবে কাফির সম্প্রদায়।”

দোয়া কুনুতে আরও যা পড়তে পারবেন

দোয়া কুনুতের জন্য সুনির্দিষ্ট কোনো দোয়া নেই। সাধারনভাবে দোয়া কুনুত হলো মহান আল্লাহর সাথে বান্দার একান্ত প্রেমালাপ, ক্ষমা প্রার্থনা ও চাওয়া-পাওয়া পূরনের আবদার। বিতর সালাতে শুধু যে উপরোক্ত আরবি দোয়াটিই পড়তে হবে, তা নয়। এবং হুবহু রাসূলুল্লাহ (সাঃ) -এর বর্নিত শব্দের অনুরূপ দোয়া করাও ওয়াজিব নয়। বরং মুমিন ব্যক্তিরা সেই স্থলে অন্য কোন দোয়াও পড়তে পারেন নিজের অবস্থাভিত্তিক চাহিদা তুলে ধরে।

হাদিসে উল্লেখিত শব্দের বাইরেও আরো কিছু ফজিলতপূর্ণ ও বরকতময় শব্দ, এমনকি কোরআনের ফজিলতপূর্ণ আয়াত সমূহও পড়া জায়েজ। আল্লাহর কাছে দোয়া-প্রার্থনা করে দোয়া সম্বলিত কোরানের এক বা একাধিক আয়াত পড়লেও কুনুতের উদ্দেশ্য হাসিল হয়ে যাবে। তবে সর্বোত্তম হলো মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) -এর শেখানো হাদিসে উল্লেখিত দোয়াটি পড়া। দোয়া কুনুতের সময় আরও করতে পারেন মহান আল্লাহ তা’আলার বাণী:

আরবি: رَبَّنَا لَا تُزِغْ قُلُوبَنَا بَعْدَ إِذْ هَدَيْتَنَا وَهَبْ لَنَا مِنْ لَدُنْكَ رَحْمَةً إِنَّكَ أَنْتَ الْوَهَّابُ  [آل عمران

বাংলা উচ্চারণ: “রাব্বানা লা তুযিগ ক্বুলু বানা বা’দা ইজ হাদাই-তানা; ওয়াহাব লানা মিন্-লাদুনকা রাহমাতান; ইন্নাকা আনতাল ওয়াহ্হাব।”

বাংলা অর্থ: “হে আমাদের পালনকর্তা! সরল পথ প্রদর্শনের পর আপনি আমাদের অন্তরকে সত্য লংঘনে প্রবৃত্ত করবেন না এবং আপনার নিকট থেকে আমাদিগকে অনুগ্রহ দান কর। আপনিই সব কিছুর দাতা।” (সুরা আলে ইমরান, আয়াত: ৮)

এছাড়াও অন্যান্য ফজিলতপূর্ণ কোরআনের আয়াতগুলো পড়তে পারেন।

বিতর নামাজ পড়ার নিয়ম

বিতর নামাজের নিয়ম প্রায় অন্য ফরজ নামাজের মতো। তবে নিয়মের ক্ষেত্রে কিছুটা ভিন্নতা রয়েছে। বেতের নামাজ কয়েক ভাবে পড়া যায়। বাংলাদেশের প্রচলিত বিতর নামাজের নিয়মটি বিভিন্ন আলেমগণের কাছে গ্রহণযোগ্য এবং সাহাবিদের আমলের মাধ্যমে প্রমাণিত একটি নিয়ম। তবে এটি ছাড়াও আরো দুইটি প্রসিদ্ধ নিয়ম রয়েছে। বিতর নামাজ পড়ার ৩টি নিয়ম নিচে তুলে ধরা হলো:

বিতর নামাজের নিয়ম ১: 

  • প্রথমে বিতর নামাজের নিয়ত করে নিতে হবে। 
  • এবার ২ রাকাত নামাজ পড়ে প্রথম বৈঠকে বসবে এবং তাশাহহুদ পড়বে। কিন্তু এই সময় সালাম ফেরাবে না। 
  • এরপর তৃতীয় রাকাত পড়ার জন্য উঠে সূরা ফাতিহা পড়বে। 
  • এরপর অন্য কোনো সুরা বা আয়াত মিলাবে। 
  • অন্য কোন সুরা বা আয়াত মিলানোর পর তাকবীর দিয়ে দুহাত কান পর্যন্ত উঠাবে এবং তাকবীরে তাহরিমার মতো হাত বাঁধবে। 
  • হাত বেঁধে নিঃশব্দে (অনুচ্চ স্বরে) দোয়া কুনুত পড়বে। 
  • দোয়া কুনুত শেষ করে আগের মতো রুকু-সিজদা করবে। 
  • তারপর শেষ বৈঠকে তাশাহহুদ, দুরুদ ও দোয়া মাসুরা পড়ে সালাম ফিরিয়ে নামাজ শেষ করবে।

বিতর নামাজের নিয়ম ২: 

  • প্রথমে বিতর নামাজের নিয়ত করে, ২ রাকাত নামাজ পড়ে সালাম ফিরাবে। 
  • অতঃপর পুনরায় ১ রাকাত পড়বে। এক্ষেত্রে অন্যান্য ফরজ নামাজের মতোই রুকু-সেজদা করে এবং ২ বারই শেষ বৈঠকে তাশাহহুদ, দুরূদ ও দোয়া মাসুরা পড়ে সালাম ফিরিয়ে নামাজ শেষ করবে।

এ পদ্ধতিটির বিশ্বস্ত দলিল রয়েছে। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমার (রাঃ) থেকে বর্ণিত- “জনৈক সাহাবী রাতের সালাত সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) কে জিজ্ঞেস করল। তখন রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বললেন, রাতের নামাজ দু-দু রাকাত করে, যখন ফজর হওয়ার আশংকা করবে, তখন এক রাকাত বিতর পড়ে নিবে।” (সহীহ বুখারী, সহীহ মুসলিম)

এ পদ্ধতি অনুযায়ী বিতর মূলত এক রাকাতই বোঝানো হয়েছে‌। হযরত ইবনে উমার (রাঃ) কে জিজ্ঞেস করা হলো দু-দু রাকাত মানে কি? তিনি বললেন- “প্রত্যেক দুই রাকাত পর পর সালাম ফিরাবে।” (মুসলিম: ১২৫২)। হযরত ইবনে উমার (রাঃ), ইমাম মালেক, শাফেয়ী, আহমেদ, ইসহাক, প্রমুখ এভাবেই বিতর সালাত আদায় করতেন।

এছাড়াও, হযরত আয়েশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন- “আমি বাড়িতে থাকা অবস্থায় রাসূলুল্লাহ (সাঃ) কক্ষের মধ্যে নামায পড়তেন। তিনি দুই রাকাত এবং এক রাকাতের মাঝে পৃথক করতেন, এসময় তিনি আমাদেরকে শুনিয়ে জোরে সালাম দিতেন।” (আহমাদ: ২৩৩৯৮)

বিতর নামাজের নিয়ম ৩:

এক্ষেত্রে,

  • প্রথমে বিতর নামাজের নিয়ত করে, ২ রাকাত নামাজ পড়ে তাশাহুদ এর জন্য না বসে সালাম না ফিরিয়ে একাধারে তিন রাকাত পড়ে সালাম ফেরানো। 

এ পদ্ধতিটির দলীল হলো:, হযরত আয়েশা (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন- 

“রাসূলুল্লাহ (সাঃ) ৩ রাকাত বিতর নামায পড়তেন। এর মধ্যে তাশাহুদের জন্য বসতেন না, একাধারে তিন রাকাত পড়ে শেষ রাকাতে বসতেন ও তাশাহুদ পড়তেন। এভাবেই বিতর পড়তেন আমীরুল মুমিনীন – ‘হযরত ওমর বিন খাত্তাব (রাঃ)’।” ইমাম হাকেম এই হাদিসটি বর্ণনা করে, তা সহীহ বলেছেন।

বিতর নামাজের নিয়ত

নিয়ত অন্তরের সাথে সম্পৃক্ত। তাই মনে মনে নিজের মাতৃভাষায় মহান আল্লাহর সন্তুষ্টির ভাবনা জ্ঞাপন করে নিয়ত করতে পারেন। তবে বিতরের নামাজের জন্য বহুল প্রচলিত একটি আরবি নিয়ত রয়েছে। সহিশুদ্ধ ভাবে পড়তে পারলে, নিম্নোক্ত নিয়তি অনুসরণ করতে পারেন।

আরবি: نويت أن أصلي لله تعالى تلك ركعات صلاة الوتر وأحب الله تعالى متوجها إلى جهة الكعبة الشريفة الله اكبر

বাংলা উচ্চারণ: “নাওয়াইতু-আন উসাল্লিয়া লিল্লাহি তা’আলা ছালাছা রাক’আতাই সালাতিল বিতরি ওয়াজিবুল্লাহি তা’আলা মুতাওয়াজ্জিহান ইলা জিহাতিল কা’বাতিশ শারীফাতি ‘আল্লাহু আকবার’।”

বিতর নামাযের নিয়ত বাংলায়

আমি কেবলামুখী হয়ে মহান আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য বিতরের তিন রাকাত ওয়াজিব নামায আদায় করছি, ‘আল্লাহু আকবার’।

১ রাকাত বিতর নামাজ পড়ার নিয়ম

১ রাকাত নামাযের ক্ষেত্রে সাধারণ নিয়মে, নিয়ত করে ‘আল্লাহু আকবর’ বলে হাত বাঁধবে। তারপর ছানা পড়ে, ‘সূরা ফাতিহা’ এর সাথে অন্য সূরা মিলিয়ে রুকু করবে। রুকু থেকে উঠে মুনাজাতের মতো ২ হাত তুলে বা হাত বুকে বেধে ‘দুয়া কুনুত’ পাঠ করবে। আবার রুকুর আগেও সূরা মিলানোর পর দোয়া কুনুত পাঠ করা যায়। উভয়টাই জায়েজ। দোয়া কুনুত পাঠ করে তারপর সিজদায় যাবে এবং শেষ বৈঠকে বসে তাশাহহুদ, দুরূদ ও দোয়া মাসুরা পাঠ করে সালাম ফিরিয়ে নামাজ শেষ করবে।

বিতর নামাজ কত রাকাত ও সহিহ নিয়ম কোনটি

বিতর নামাজের রাকাত সংখ্যা নির্দিষ্ট নয়। এই নামায ১, ৩, ৫, ৭, ৯, ১১ ও ১৩ রাকাত পর্যন্ত পড়া যায়।

আরও পড়ুন: ঈদের নামাজ পড়ার নিয়ম, নিয়ত ও বিধানসমূহ 

আবদুল্লাহ ইবনে আবি কাইস (রাঃ) বলেন, আমি আয়েশা (রাঃ)-এর কাছে জিজ্ঞাসা করলাম যে নবীজি (সাঃ) বিতরে কত রাকাত পড়তেন? জবাবে তিনি বলেন, চার এবং তিন, ছয় এবং তিন, আট এবং তিন, দশ এবং তিন। তিনি বিতরে সাত রাকাতের কম এবং ১৩ রাকাতের বেশি পড়তেন না। (সুনানে আবু দাউদ, তাহাবি শরিফ, মুসনাদে আহমদ)

উপরোক্তভাবে বিতর নামাজের বিভিন্ন প্রকার নিয়ম হাদিসে উল্লেখিত রয়েছে।

শেষকথা

উপরোক্ত আলোচনা অনুযায়ী যে কোন একটি বিতর নামাজ পড়ার নিয়ম অনুসরন করলেই নামাজ আদায় হয়ে যাবে, ঈন-শা-আল্লাহ। মহান আল্লাহ তা’আলা আমাদেরকে সহীহ-শুদ্ধভাবে আল্লাহর ইবাদত করার তৌফিক দান করুক, আমিন।

Scroll to Top