মিশরীয় সভ্যতার ইতিহাস

মিশরীয় সভ্যতার ইতিহাস

মানব ইতিহাসের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রাচীন সভ্যতা হলো মিশরীয় সভ্যতা। প্রায় ৬ হাজার বছর পূর্ব থেকে মিশরীয়রা অর্থবিত্ত, জাকজমক, সম্পদ, শিল্প উৎপাদন, সেনাবাহিনী, প্রযুক্তি ইত্যাদি সব দিক থেকেই পৃথিবীর সবচেয়ে অগ্রগামী সভ্যতা হয়ে উঠেছিল। পিরামিড আর মমি’র মত বিজ্ঞান তারা জেনেছিল খ্রিস্টের জন্মেরও কয়েক হাজার বছর পূর্বে। তাছাড়া পৃথিবীর সপ্তাশ্চর্যের মধ্যে একটি হলো মিশরের দ্যা গ্রেট পিরামিড অব গিজা (The Great Pyramid of Giza)। প্রাগৈতিহাসিক সেই সভ্যতার অস্তিত্ব বর্তমানে না থাকলেও মানব সভ্যতার ক্রমবিকাশে মিশরীয়দের অবদান ছিল ব্যাপক। তাই মিশরীয় সভ্যতার অবদান, ইতিহাস, লিখন পদ্ধতি, ধর্ম, সমাজ ব্যবস্থা, আইন, ব্যবসা-বাণিজ্য, কৃষি ও মিশরীয় সভ্যতার পতন সম্পর্কে জানতে পারবেন এই লেখা থেকে।

মানব সভ্যতার বিকাশে মিশরীয় সভ্যতার অবদান

মানব সভ্যতাকে বর্তমান বিশ্বে উন্নীত করতে মিশরীয়দের অবদান অনবদ্য। সাহিত্য, কলা, প্রযুক্তি, চিকিৎসা, বিজ্ঞান, উদ্ভাবনী গবেষণা, লিখন পদ্ধতি, রাষ্ট্র ও সমাজ নিয়ন্ত্রণ, আইন, প্রসাশন, ব্যবসা-বাণিজ্য, অর্থনীতি ইত্যাদিতে তাদের অবদান ছিল ব্যাপক। মিশরীয় বিজ্ঞানের প্রথম ধাপ ছিল জ্যোতির্বিদ্যা ও গণিত শাস্ত্রের বিকাশ। তারা জ্যোতির্বিদ্যার উন্নয়নের মাধ্যমে বর্ষপঞ্জী, কৃষি অর্থনীতির প্রয়োজনে গ্রহ নক্ষত্র পর্যবেক্ষণ, গণিত শাস্ত্রের বিকাশ করে পাটিগণিত ও জ্যামিতির উদ্ভাবন করেছিলেন। 

তারা যোগ, বিয়োগ ও ভাগ পদ্ধতির উদ্ভাবন করেছিল, তবে গুন আবিষ্কার করতে পারেনি। অন্যদিকে তারা দশমিকের হিসাব জানলেও শুন্য (০) আবিষ্কার করতে পারেনি। পিরামিড নির্মাণ কাজের জন্য অপরিহার্য জ্যামিতিক জ্ঞান আয়ত্ত করতে পেরেছিল তারা। প্রমাণস্বরূপ, চুনাপাথরের টুকরোগুলো নির্দিষ্ট অবস্থানে আনার জন্য পিরামিড নির্মাতাদের তা সঠিক মাপে কাটতে হতো। এছাড়াও পিরামিড তৈরীর জন্য ও অন্যান্য কাজের জন্য ত্রিভুজ, চতুর্ভুজ, বহুভূজ ও বৃত্তের ক্ষেত্রফল এবং সিলিণ্ডার পিরামিড প্রভৃতির ঘনফল তারা নির্ণয় করতে পারতো। 

তাদের সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী ও পরিপূর্ণ ভাষা ছিল মিশরীয়, কস্টিক ও গ্রীক। চিকিৎসা বিজ্ঞান চিকিৎসাবিজ্ঞানে প্রাচীন মিশরীয়রা গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে। প্রথমদিকে তাদের চিকিৎসা কুসংস্কারাচ্ছন্ন থাকলেও, ধীরে ধীরে তা বিজ্ঞানসম্মত রূপ লাভ করে। খ্রীষ্টপূর্ব ১৭০০ অব্দের দিকে মিশরীয় চিকিৎসকগণ বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গীতে রোগ নির্ণয় শুরু করে। 

৬ষ্ঠ রাজবংশের একজন প্রধান চিকিৎসক ছিলেন, যিনি একাধারে দন্ত বিশেষজ্ঞ, চক্ষু চিকিৎসক এবং পাকস্থলী অস্ত্রের চিকিৎসক হিসেবে খ্যাতি অর্জন করছিলেন। চিকিৎসা বিজ্ঞানীগণ সর্বপ্রথম মানুষের হৃৎপিণ্ডের গুরুত্ব নির্দেশ করেছিলেন এবং তাদের নাড়ীর স্পন্দন সম্পর্কেও ধারণা ছিল। ভাঙ্গা, মচকানো এবং ছোট খাট অপারেশনও তারা করতে পারতো তারা। কৃষি ক্ষেত্রে জলসেচ, লাঙ্গলের ব্যবহার, জমি চাষ, ফসল কাটা ও উৎপাদন তারা আয়ত্ত করেছিল। বিনিময় প্রথার প্রচলন, আমদানি-রপ্তানি ইত্যাদিতে তারা অগ্রগামী ছিল।

মিশরীয় সভ্যতা কোথায় গড়ে উঠেছিল

মিশরীয় সভ্যতা উত্তর আফ্রিকার পূর্বাঞ্চলে তিনটি মহাদেশ দ্বারা ঘিরে থাকা মিশরের ভৌগোলিক অবস্থানে গড়ে উঠেছিল। এই অঞ্চলটি এশিয়া, আফ্রিকা ও ইউরোপ মহাদেশ দ্বারা পরিবেষ্টিত ভূমধ্যসাগরের উপকূলে অবস্থিত। প্রাচীন মিশরীয় সভ্যতা গড়ে উঠেছিল নীল নদকে ঘিরে। এর উত্তরে ভূমধ্যসাগর, পূর্বে লোহিত সাগর, পশ্চিমে সাহারা মরুভূমি, দক্ষিণে সুদান ও আফ্রিকার অন্যান্য দেশ অবস্থিত। বর্তমানের মিশর/ ইজিপ্ট -এর মোট আয়তন প্রায় চার লক্ষ বর্গমাইল।

মিশরীয় সভ্যতার ইতিহাস

পৃথিবীর প্রাচীনতম সভ্যতাগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো মিশরীয় নগরী। মিশরের ইতিহাস বিশ্বের সবচেয়ে সুদীর্ঘ ও সমৃদ্ধ ইতিহাস হিসেবে সমাদৃত রয়েছে। ধারণা করা হয়, ৬০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে মিশরে নিল নদ উপত্যকায় প্রথম মানব বসতি স্থাপন করা হয়। পৃথিবীর প্রাচীন ও দীর্ঘতম নদ- নীলনদের জন্য প্রাচীন মিশরীয়রা বিশেষভাবে খ্যাতি অর্জন করেছিল। তবে মিশরের প্রাচীন ইতিহাসের অধিকাংশ তথ্য আবৃত রয়েছে রহস্যে। কিছুকাল পূর্বে রোসেটা স্টোন এর সহায়তায় মিশরীয় হায়ারোগ্লিফিক্সের গুপ্ত সংকেতসমূহের পাঠোদ্ধারের মাধ্যমে প্রাচীন ইতিহাসের কিছু তথ্য উদঘাটন করা সম্ভব হয়েছে।

ঐতিহাসিক নিদর্শন গুলোর মধ্যে মিশরের পিরামিড, মমি, কিছু ফলক, পাথরে খোদাই করার চিত্রলিখন ও অন্যান্য স্তম্ভ রয়েছে। আনুমানিক, ৩১৫০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে প্রথম রাজবংশের ‘ফারাও’ রাজা নারমার অধীনে প্রাচীন মিশরীয় সভ্যতায় ঊর্ধ্ব ও নিম্ন মিশরকে একই রাজ্যের আওতাভুক্ত করা হয়। পরবর্তীতে, মিশরের স্থানীয় আদিবাসীদের শাসন খ্রিস্টপূর্ব ষোড়শ শতকে হাখমানেশি সাম্রাজ্যের আক্রমণের আগ পর্যন্ত টিকে ছিল। খ্রিস্টপূর্ব ৩৩২ সনে মেসিডেনীয়ান শাসক আলেকজান্ডার দ্যা গ্রেট হাখমানেশিদের পরাস্ত করে মিশর দখল করেন এবং হেলেনীয় টলেমাইক রাজবংশের শাসন প্রতিষ্ঠা করে। পরবর্তীতে, টলেমাইক শাসকদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ এবং অভ্যন্তরীণ গৃহযুদ্ধের কারণে এই শাসনব্যবস্থার পতন ঘটে এবং রোমান শাসকরা মিশর দখল করে মিশরকে রোমানের একটি সাম্রাজ্য বানায়। 

মিশরীয় সভ্যতার লিখন পদ্ধতি

প্রাচীন মিশরীয়দের নিজস্ব লিখন পদ্ধতি ছিল, যার নাম ছিল চিত্রলিখন রীতি। ধারনা করা হয়, মিশরীয়রাই সর্বপ্রথম লিখন পদ্ধতি আবিষ্কার করেছিল। প্রায় ৫ হাজার বছর পূর্বে তারা সর্বপ্রথম ২৪টি ব্যঞ্জনবর্ণের বর্ণমালা আবিষ্কার করেছিল। প্রতিটি চিহ্নের একটি বিশেষ অর্থ ছিল। এই চিহ্নগুলো পাশাপাশি বসিয়ে শব্দ প্রকাশ করা হতো। মূলত ধর্ম এবং রাজার আদেশ প্রচারের জন্যে এ ধরনের লিপি ব্যবহার করা হতো। পরবর্তীতে, চিত্রভিত্তিক থেকে অক্ষরভিত্তিক এবং শেষে বর্ণভিত্তিক লিপি ব্যবহৃত হয় মিশরে। 

তারা প্রথমে পাথর বা কাঠের গায়ে খোদাই করে লিখতো। মিশরীয়রা নলখাগড়া জাতীয় গাছের কাণ্ড থেকে কাগজ বানিয়ে বানিয়ে ব্যবহার করতে থাকে। গ্রিক সভ্যতার লোকেরা এই কাগজের নাম দেয় ‘প্যাপিরাস’। মূলত এই শব্দ থেকে ইংরেজি পেপার শব্দের উৎপত্তি। 

প্রাচীন মিশরীয় সভ্যতার ধর্ম

মিশরীয় সভ্যতা ধর্মীয় বিশ্বাসের কারণে পৃথিবীতে ভিন্নভাবে পরিচিতি লাভ করেছে প্রাচীনকাল থেকে। প্রাচীন মিসরীয়দের সামাজিক, রাষ্ট্রীয়, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক জীবনের প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে ধর্মীয় অনুশাসনের প্রতিফলন দেখা যায়। ঐতিহাসিক তথ্য মতে, প্রাচীন জাতি সমূহের মধ্যে মিসরীয়রাই প্রথম ধর্মীয় বিশ্বাসের প্রচলন করে। প্রায় ৩ হাজার বছরেরও বেশি সময় ধরে মিশরে পৌরাণিক ধর্মীয় বিশ্বাসের প্রচলন ছিল। 

পৌরানিক ধর্মে মূলত বহু দেব-দেবীর প্রচলন ছিল। কিন্তু প্রাচীন সাম্রাজ্যের কালে ‘আখেনআতেন’ -এর শাসনামলে কিছুকালের জন্য সূর্যদেব আতেনকে কেন্দ্র করে একেশ্বরবাদের চর্চা করতে দেখা গিয়েছিল। পরবর্তীতে, আখেনআতেনের মৃত্যুর সাথে এই চর্চাও লোপ পায় এবং আগের বহু দেব-দেবী সংবলিত পৌরানিক ধর্ম ফিরে আসে। মিসরীয়দের পুর্নজীবনের প্রতি এবং দোযখ ও বেহেস্তের প্রতি তাদের পূর্ণবিশ্বাস ছিল। পরবর্তীতে, এই বহুমুখী ধর্মীয় বিশ্বাসের পরিবর্তন করতে ‘হযরত মুসা (সাঃ)’ -এর আগমন হয় এবং মিশরে ইসলাম প্রতিষ্ঠা হয়েছিল।

মিশরীয় সভ্যতার সমাজ ব্যবস্থা

প্রাচীন মিশরের সভ্যতার প্রশাসনিক ব্যবস্থা এবং দেশের সামগ্রিক কার্যক্রম রাজাদের নির্দেশকে কেন্দ্র করে হতো। মিশরের রাজাদের ফারাও বলা হতো। ফারাওকে রাজকীয়তা এবং ক্ষমতার চিহ্ন পরিহিতরূপে চিহ্নত করা হতো। ফারাও শব্দের অর্থ বাড়ি বা দালান। ধারণা করা হয়, ফারাওরা বিশালাকৃতির প্রাসাদে বসবাস করতো বলে তাদের এমন নামকরণ করা হয়েছে। ফারাওরা ছিলো দেশের সর্বময় রাজা এবং অন্তত তাত্ত্বিকভাবে তারা দেশের সমগ্র ভূমি এবং সম্পদের উপর কর্তৃত্বশালী ছিল। ফারাওরা মূলত সেনাবাহিনীপ্রধান এবং সরকারপ্রধান এবং কার্যসম্পাদনে একদল আমলার উপর নির্ভর করতো।

মিশরীয় রাজাদের প্রশাসনের দায়িত্ব পালন করতেন উজীর। উজীররা ছিলেন ফারাওয়ের প্রতিনিধি, তিনি ভূমি জরিপ কাজ, কোষাগার, নির্মাণ প্রকল্প, বিচার ব্যবস্থা এবং আর্কাইভের মধ্যে সমন্বয় সাধন করতেন। পুরো মিশর ৪২ টি নোমে বিভক্ত ছিল। প্রতিটি নোমের প্রশাসক নোমর্ক, তার কাজের জন্য উজীরের কাছে জবাবদিহি করতো। মিশরীয় সমাজ ব্যবস্থার ধারাবাহিকতা ছিল নিম্নরূপ: (১) রাজ পরিবার, (২) পুরোহিত শ্রেণী, (৩) অভিজাত সম্প্রদায়, (৪) ব্যবসায়ী শ্রেণী, (৫) লিপিকার, (৬) শিল্পী, (৭) কৃষক ও ভূমিদাস। মিশরীয় রাজাদের রাজবংশের তালিকা বেশ দীর্ঘ ছিল। ৩১ টি রাজবংশের ৩০০ এর বেশি ফারাও মিলে প্রায় ৩০০০ বছর এই সভ্যতা সমহিমায় উজ্জ্বল রেখেছিল।

মিশরীয় সভ্যতার আইন ও শাসন 

মিশরীয় আইন পরিচালনার প্রধান ছিলেন ফারাও বা রাজারা। মূলত তাদের দায়িত্ব ও তত্ত্বাবধানেই আইন তৈরি করা, ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা এবং আইন-শৃঙ্খলা বজায় রাখা হতো। আদালতের নথি থেকে বোঝা যায় যে মিশরীয় আইন ভাল মন্দের সাধারণ ধারণার উপর গড়ে উঠেছিল। সেখানের কিছু আইনে কঠোরতা অনুসরণের চেয়ে দ্বন্দ্ব নিরসনকে অধিক গুরত্ব দেওয়া হতো। স্থানীয় বয়স্কদের নিয়ে কেনবেত কাউন্সিল গঠন করে ছোটোখাটো ব্যাপার মীমংসা করা হতো। 

অন্যদিকে হত্যা, বড় ভূমি বিনিময় এবং সমাধি লুটের ক্ষেত্রে মহাকেনবেতের কাছে উপস্থাপন করা হত, যার সভাপতিত্ব করতেন উজীর কিংবা ফারাও। ছোট কিংবা বড় যে অপরাধের জন্যই মামলা হোক না কেন, আদালতের লিপিকারেরা অভিযোগ, সাক্ষী এবং রায় ভবিষ্যতের জন্য নজীর হিসাবে নথিবদ্ধ করে রাখত।

মিশরীয় সভ্যতার অর্থনীতি ও ব্যবসা-বানিজ্য 

প্রাচীন মিশরের প্রধান অর্থনীতি এবং ব্যবসা-বাণিজ্য ছিল কৃষিকাজকে ঘিরেই। কৃষিকাজ ছাড়াও তৎকালীন মিশরীয়রা বিভিন্ন ধরনের মাটির পাত্র, বিভিন্ন ধরণের হাতিয়ার ও অস্ত্রশস্ত্র ইত্যাদি উৎপাদন করত। বাণিজ্যের ক্ষেত্রে তারা পাথর শিল্প, নৌযান তৈরী, মাটির পাত্র ইত্যাদি রপ্তানি করতো এবং সোনা, রূপা, হাতির দাঁত, কাঠ ইত্যাদি আমদানি করতো। তখন মিশরীয়দের মাঝে মুদ্রার প্রচলন না হলেও তারা এক ধরনের দ্রব্য বিনিময় ব্যবস্থা অনুসরণ করতো। তাদের ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালিত হতো ফিলিস্তিন, সিরিয়া, ফিনিশিয়া ও ক্রীট দ্বীপের সাথে।

এক্ষেত্রে নির্দিষ্ট পরিমাণের খাদ্যশস্যের বস্তা কিংবা ‘দেবেন’ ছিল তাদের বিনিময়ের একক। শ্রমিকদের খাদ্যশস্যের মাধ্যমে পারিশ্রমিক দেওয়া হতো। দ্রব্যমূল্যের দাম সারা দেশে নির্দিষ্ট করা ছিল। একটি জামার মূল্য ৫ দেবেন এবং একটি গরুর মূল্য ১৪০ দেবেন, এভাবেই ক্রয়-বিক্রয় হতো। খ্রীষ্টপূর্ব ৫ম শতকে বিদেশিদের দ্বারা মুদ্রার প্রচলন হয়। এগুলো ছিল দামি ধাতুর নির্দিষ্ট পরিমাণ খন্ড, প্রকৃত মুদ্রা ছিল না। কিন্তু পরবর্তী শতকে আন্তর্জাতিক ব্যবসায়িরা ধাতব মুদ্রার উপর নির্ভর করতে শুরু করে।

মিশরের প্রাক-রাজবংশিয় যুগে নুবিয়ার সাথে সোনা এবং ধূপ সংগ্রহের জন্য নুবিয়ার সাথে বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপিত হয়। ২য় রাজবংশের সময় জুবাইলের হতে কাঠ আমদানি করা হতো। ৫ম রাজবংশীয় যুগে পুন্ট থেকে সোনা, সুগন্ধী রেসিন, আবলুস, হাতির দাঁত এবং বন্য প্রাণী, যেমন- বানর ও বেবুন আমদানি শুরু হয়। আনাতোলিয়া থেকে টিন এবং প্রয়োজনীয় অতিরিক্ত তামার সংগ্রহ করা হতো। বিভিন্ন বিলাস সামগ্রীর বিনিময়ে মিশর থেকে প্রধানত খাদ্যশস্য, লিনেন, সোনা, প্যাপিরাস এবং কাচ ও পাথরের বিভিন্ন সামগ্রী নিতো অন্যান্য সভ্যতাগুলো।

মিশরীয় সভ্যতার কৃষি ব্যবস্থা

প্রাচীন মিশরীয় অর্থনীতি মূলত কৃষির উপর নির্ভরশীল ছিল। আর এই কৃষিভিত্তিক অর্থনীতি উন্নয়নের পেছনে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে নীল নধ। নীল নদে প্রায় বাৎসরিক বন্যা হতো, যা নীল নদের পার্শ্ববর্তী মাটিকে উর্বর করে তুলতো। ফলে প্রাচীন মিশরীয়রা প্রচুর পরিমাণে খাদ্য উৎপাদন করতে পারতো। 

কৃষক ও ভূমিদাস কৃষিকাজে নিয়োজিত থাকতো। তারা প্রাক-রাজকীয় যুগ থেকেই চাষের জন্যে লাঙ্গলের ব্যবহার শুরু করে। কৃষি কাজের জন্যে জল-সেচ, জলাশয়কে কৃষিক্ষেত্রে রূপান্তরিত করার কৌশল তারা আবিস্কার করেছিল সেকালেই। মিশরীয়রা কৃষিকাজের জন্য প্রধানত ৩টি ঋতু চিহ্নিত করেছিল। যথা: (১) আখেত বা বন্যাঋতু, (২) পেরেত বা রোপনঋতু এবং (৩) শেমু বা ফসল কাটার ঋতু। 

তারা গম, বার্লি, যব, তুলা, পেঁয়াজ অন্যতম কৃষিজ পণ্য ছিল। শণগাছ চাষ করা হতো লিনেন এবং কাপড় তৈরির তন্তুর জন্য। ফল ও সবজির মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল পেঁয়াজ, রসুন, তরমুজ, আঙুর, স্কোয়াশ, লেটুস, ডাল এবং অন্যান্য ফসল।

মিশরীয় সভ্যতার সময়কাল এবং মিশরীয় সভ্যতার পতন

প্রাচীন মিশরীয় সভ্যতা ২৫০০ বছরেরও বেশি সময়কাল পর্যন্ত স্থায়ী হয়েছিল। প্রাচীন মিশরের নিরবচ্ছিন্ন ও দীর্ঘ ইতিহাসের সূচনা হয়েছিল প্রায় ৬০০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের নবোপলীয় যুগে। পরবর্তীতে, মিশরীয় সভ্যতার গোড়াপত্তন হয় মেনেসের নেতৃত্বে। এই সভ্যতার গোড়াপত্তন হওয়ার পর থেকে প্রায় ৩,০০০ বছর ধরে স্বমহিমায় উজ্জ্বল ছিল।

আরও পড়ুন: পৃথিবীর সবচেয়ে ভয়ংকর ও শক্তিশালী ১০টি ভূমিকম্প

মিশরীয় সভ্যতার ২০তম রাজবংশের শেষ সম্রাট ছিলেন একাদশ রামসিস। তার সময়কালে মিশরে গৃহযুদ্ধের সূচনা হয়। পরবরর্তীতে, ১০৮০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে মিশরের থিবস শহরের প্রধান ধর্মযাজক মিশরের সিংহাসন দখল করে নেয়। খ্রিষ্টপূর্ব ১০ম শতকে লিবিয়ার এক বর্বর জাতি ফারাওদের সিংহাসন দখল করে নেয়। ৬৭০-৬৬২ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে অ্যাসিরীয়রা মিশরে আধিপত্য বিস্তার করে। ৫২৫ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে পারস্য রাজশক্তি মিশর দখল করে মিশরীয় সভ্যতার অবসান ঘটায়। 

শেষকথা

প্রাচীন সভ্যতার দিক থেকে মিশরীয় সভ্যতা ছিল স্বয়ংসম্পূর্ণ ও অপ্রতিদ্বন্দ্বী। উপরোক্ত তথ্যের আলোকে, সেই মিশরীয় সভ্যতা বর্তমানে ইজিপ্ট হয়ে পৃথিবীর বুকে টিকে রয়েছে।

About Durud Ahmed

সম্মানিত ভিজিটর আমি দুরুদ আহমেদ,পেশায় আমি একজন ব্লগ লেখক। প্রযুক্তি ও শিক্ষা, ইতিহাস-ঐতিহ্য, লাইফস্টাইল এবং ইসলামিক লেখাই আমার প্রিয়। এই ব্লগের মাধ্যমে আমি সঠিক তথ্য প্রদানের মাধ্যমে ভিজিটরদের সহযোগিতা করাই মূল লক্ষ্য।