জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং কি? এর প্রকারভেদ, কার্যপদ্ধতি, ব্যবহার ও ক্যারিয়ার গঠন

জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং (Genetic Engineering) বলতে জীবের বংশাণু, ডিএনএ ও অন্যান্য নিউক্লিক অ্যাসিড -এর কৃত্রিম পরিবর্তনের কৌশলকে বোঝানো হয়। উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে জীববিজ্ঞানের একটি অত্যাধুনিক শাখা হলো বায়োটেকনোলজি ও জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং। কৃষি, চিকিৎসা, নানান যৌগিক গবেষণাসহ মানবদেহের অঙ্গপ্রত্যঙ্গের উন্নয়নে জীনতত্ত্ব প্রকৌশলী গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলে। তাই জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং কি, এর প্রকারভেদ, কার্যপদ্ধতি, ব্যবহার ও ক্যারিয়ার গঠনের ক্ষেত্রে এর উপযোগিতা সম্পর্কে জেনে নিতে পারেন এই লেখা থেকে।

জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং কি?

জীনতত্ত্ব প্রকৌশলী হলো একটি প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে কোন জীবের জিনোম পরিবর্তন করা যায়। একটি জীবের ডিএনএতে অন্য কোন জীবের কাঙ্খিত বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন ডিএনএ স্থাপনের মাধ্যমে কোন জীবের জিনোমকে নিজের সুবিধানুযায়ী সাজিয়ে জীবের বৈশিষ্ট্যের পরিবর্তন ঘটানোই জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং। 

জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং এর অপর নাম জেনেটিক মডিফিকেশন (Genetic Modification)। জীনতত্ত্ব প্রকৌশলী মূলত বায়োকেমিস্ট্রি, মাইক্রোবায়োলজি, ইমিউনোলজি, মলিকুলার বায়োলজি, জেনেটিকস ইত্যাদি বিষয়ের একটি সমন্বিত রূপ। উন্নত বৈশিষ্ট্যধারী উদ্ভিদ ও প্রাণী সৃষ্টিতে কিংবা কোন জীবে নতুন কোন বৈশিষ্ট্য সংযুক্ত করতেই জীনতত্ত্ব প্রকৌশলী ব্যবহার করা হয়। বর্তমানে আমাদের কৃষি থেকে শুরু করে চিকিৎসা পর্যন্ত, বহু ক্ষেত্রে জীনতত্ত্ব প্রকৌশলী গুরুত্বপূর্ণ উদ্বাবনী ভূমিকা পালন করছে।

জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং কাকে বলে | জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং বলতে কি বুঝায়

কোন জীবের কোষ থেকে একটি নির্দিষ্ট জিন বহনকারী ডিএনএ খন্ডানু কেটে বিচ্ছিন্ন করে ভিন্ন একটি জীব কোষের ডিএনএ এর সাথে জোড়া দিয়ে, ধারণকারী জিবে কাঙ্খিত বৈশিষ্ট্যের প্রকাশ ঘটানোর কৌশলকেই জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং বলে।

জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং কাকে বলে
জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং কাকে বলে

সাধারণত একটি প্রাণীর জিনগুলোই সেই প্রাণীর সকল বৈশিষ্ট্য বহন করে। প্রাণী বা উদ্ভিদ জীবের ক্ষুদ্রতম একক বলা হয় কোষকে এবং কোষের প্রাণকেন্দ্র কে বলা হয় নিউক্লিয়াস। নিউক্লিয়াসের ভিতরে থাকে ক্রোমোজোম এবং ক্রোমোজোমের মধ্যে চেইনের মত প্যাঁচানো কিছু বস্তু থাকে, যা DNA (Deoxyribonucleic Acid) নামে পরিচিত। 

DNA বহু অংশে বিভক্ত থাকে। এর একেকটি নির্দিষ্ট অংশকে জিন বলা হয় এবং জিনগুলোই উদ্ভিদ এবং প্রাণীর বৈশিষ্ট্য বহন করে। জিনতত্ত্ব প্রকৌশলে সেই জিন নিয়ে কাজ করা হয়।

জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং এর জনক কে?

পর বার্গ (Paul Berg) কে জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের জনক বলা হয়। ১৯৭২ সালে Paul Berg বানরের ভাইরাস SV40 ও lambda virus -জীবের ডিএনএ সংযোগ ঘটিয়ে বিশ্বের প্রথম রিকম্বিনেন্ট ডিএনএ অণু তৈরি করেছিলেন। এর ফলে আধুনিক জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং এর ভিত্তি স্থাপিত হয়েছিল। 

জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং এর ইতিহাস 

জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে মানুষের কৌতূহল ও কাল্পনিক চিন্তাভাবনা ছিল বহুকাল আগে থেকেই। তবে বৈজ্ঞানিক কৌতূহল এবং প্রযুক্তিগত অগ্রগতির অভাবে সেই চিন্তাভাবনা তেমন ফলপ্রসূ হয়নি। তবে ২০ শতকের মাঝামাঝি সময় থেকে গবেষক এবং বিজ্ঞানীদের মাঝে জেনেটিক উপাদানের বিস্তীর্ণ দিকগুলো স্পষ্ট হতে থাকে। তখন থেকেই জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং পরিবর্তনের উপায় গুলো অন্বেষণ করতে শুরু করেছিলেন বিজ্ঞানীরা। 

১৯৫৩ সালে জেমস ওয়াটসন এবং ফ্রান্সিস ক্রিক দ্বারা ডিএনএর কাঠামোর আবিষ্কৃত হয়। এটি ছিল জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং যাত্রার একটি গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত। এই অগ্রগতিটি মূলত জেনেটিক তথ্য কিভাবে সংরক্ষণ এবং প্রেরণ করা যায়, তা বোঝার স্পষ্ট ভিত্তি স্থাপন করেছিল।

১৯৭০ এর দশকে রিকম্বিন্যান্ট ডিএনএ (Recombinant DNA) প্রযুক্তির বিকাশের মাধ্যমে প্রথমবারের মতো উল্লেখযোগ্য সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়। ১৯৭২ সালে পল বার্গ (Paul Berg) বিভিন্ন জীবের ডিএনএ একত্রিত করে রিকম্বিন্যান্ট ডিএনএ অণু তৈরি করতে সক্ষম হয়েছিলেন। এই সক্ষমতাই আধুনিক জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং এর ভিত্তি স্থাপন করেছিল এবং এর ফলে একটি জীব থেকে জিন ম্যানিপুলেট করে অন্য জীবের মধ্যে প্রবেশ করানোর সম্ভাবনা দেখা দেয়।

এরই ধারাবাহিকতায়, ১৯৭৩ সালে স্ট্যানলি কোহেন এবং হার্বার্ট বয়ার সর্বপ্রথম Genetically modified organisms (GMO) বা জিনগত পরিবর্তিত জীব তৈরি করেন। তাদের এই গবেষণায় একটি ব্যাকটেরিয়া থেকে অন্য একটি ব্যাকটেরিয়াতে ডিএনএ স্থানান্তর করে জেনেটিক পরিবর্তন করা হয়েছিল। স্ট্যানলি কোহেন ও হার্বার্ট বয়ারের এই উদযাপনের পর থেকেই বায়োটেকনোলজি এবং জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং এর স্পষ্ট দ্বার খুলেছে। 

১৯৮০ সালের দিকে জিনগতভাবে পরিবর্তিত উদ্ভিদ উৎপাদন এবং বাণিজ্যিকীকরণ শুরু হয়। এ সময় বিজ্ঞানীরা একটি তামাক গাছের মধ্যে একটি ভিন্ন জীব থেকে একটি জিন স্থাপন করেছিল। এর ফলে উদ্ভিদগুলোতে জেনেটিক পরিবর্তনের মাধ্যমে কীটপতঙ্গ প্রতিরোধের ক্ষমতা সৃষ্টি হয়।

আধুনিক জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং

২০১০ -এর দশকের শুরুর দিকে CRISPR-Cas9 সহ আরো বেশ কিছু জেনেটিক প্রকৌশলী বিকশিত হয়েছিল। এই সময় জিন সম্পাদনা আরো বেশি কার্যকর এবং সুনির্দিষ্ট হয়। CRISPR কৌশলটি বিজ্ঞানীদেরকে নির্ভুলভাবে কার্যক্রম পরিচালনার মাধ্যমে চিকিৎসা এবং কৃষিতে অগ্রগতির জন্য জেনেটিক প্রকৌশলী ব্যবহারের সুযোগ দিয়েছিল।

২১ শতকে এসে বিভিন্ন সময় বাস্তুতন্ত্রের উপর জেনেটিক প্রকৌশলীর প্রভাব, জিনগতভাবে পরিবর্তিত জীবন নিরাপত্তা, প্রযুক্তির অপব্যবহার ইত্যাদি বিষয় নিয়ে বিশ্বব্যাপী নেতিবাচক আলোচনা হয়। তবে বর্তমানে কৃষি কাজ, চিকিৎসা, ঔষধ শিল্প এবং নানা প্রকার উৎপাদনমুখী শিল্পে জেনেটিক প্রকৌশলী নিবিড়ভাবে মিশে গেছে। 

জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং এর প্রকারভেদ ও কার্যপদ্ধতি 

Genetic Engineering মূলত বিভিন্ন প্রকার জেনেটিক উপাদান পরিবর্তনের অনন্য প্রক্রিয়া। আধুনিক জেনেটিক প্রকৌশলের প্রধান কয়েকটি ভাগ রয়েছে। এগুলো হলো: 

  • রিকম্বিন্যান্ট ডিএনএ প্রযুক্তি;
  • CRISPR-Cas9;
  • জিঙ্ক ফিঙ্গার নিউক্লিয়াস (ZFNs);
  • ট্রান্সক্রিপশন অ্যাক্টিভেটর-লাইক ইফেক্টর নিউক্লিয়াস (TALENs);
  • জিন থেরাপি;
  • সিন্থেটিক বায়োলজি।

নিচে এই সকল কৌশলগুলো সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরা হলো: 

রিকম্বিন্যান্ট ডিএনএ প্রযুক্তি

এই পদ্ধতিতে, একটি জীবের ডিএনএ অন্য জীবের ডিএনএ-তে সন্নিবেশিত করে ডিএনএ সিকোয়েন্সের নতুন সমন্বয় তৈরি করা হয়। এটি একটি জীবের মধ্যে নির্দিষ্ট জিন স্থানান্তর করতে, পছন্দসই বৈশিষ্ট্য সহ জিনগতভাবে পরিবর্তিত জীব (GMOs) তৈরি করতে, থেরাপিউটিক প্রোটিন তৈরি করতে, জিনের কার্যকারিতা বিশ্লেষণ করতে এবং অন্যান্য কাজে ব্যবহৃত হয়।

এক্ষেত্রে ডিএনএকে সুনির্দিষ্ট বিন্দু থেকে কাটা হয়। নির্দিষ্ট কোন জীব বা উদ্ভিদ থেকে ডিএনএ কেটে বিচ্ছিন্ন করতে এন্ডোনিউক্লিজ নামক এনজাইম ব্যবহার করা হয়। বিছিন্ন করা ডিএনএ টি অন্য একটি উদ্ভিদ বা প্রাণীতে প্রবেশ করানো হয়। এর জন্য অনুরূপভাবে জিন ধারণকারী উদ্ভিদের নির্দিষ্ট স্থানটি এনজাইমের মাধ্যমে কাটা হয়। তারপর জিন ধারণকারী উদ্ভিদে পূর্বে বিচ্ছিন্নকারী ডিএনএ টি প্রবেশ করানো হয়। এরপর ডিএনএ খণ্ডের আঠালো প্রান্ত এবং ভেক্টর একত্রে আবদ্ধ হয়ে রিকম্বিন্যান্ট ডিএনএ তৈরি করে।

রিকম্বিন্যান্ট ডিএনএ প্রযুক্তিতে একটি জীবের মধ্যে নতুন বৈশিষ্ট্য তৈরি করা যায়। এই প্রযুক্তিটি বায়োটেকনোলজি, মেডিসিন, কৃষি এবং গবেষণা সহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটিয়েছে। 

CRISPR-Cas9 প্রযুক্তি

এই প্রযুক্তিটি একটি আণবিক কাঁচির মতো কাজ করে। এটি একটি ব্যাকটেরিয়াল প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা থেকে পাওয়া যায়। CRISPR একটি RNA দ্বারা পরিচালিত হয় এবং নির্দিষ্ট DNA ক্রম চিহ্নিত করে সেই সুনির্দিষ্ট অবস্থানে DNA কেটে বিচ্ছিন্ন করে। এর মাধ্যমে ডিএনএ সিকোয়েন্স পরিবর্তন ও নতুন করে সাজানো যায়।

এটি প্রয়োগ করে নির্ভুলভাবে রোগের চিকিৎসা, জিনগতভাবে পরিবর্তিত জীব তৈরি, ওষুধ ও কৃষির মতো বিভিন্ন ক্ষেত্রে লক্ষ্যযুক্ত থেরাপি তৈরি করা সম্ভব।

জিঙ্ক ফিঙ্গার নিউক্লিয়াস (ZFNs) 

Zinc Finger Nucleus মূলত জিন কে সাজানোর একটি যন্ত্র হিসেবে কাজ করে। জিঙ্ক ফিঙ্গার কৌশলটি, ডিএনএ সিকোয়েন্সকে লক্ষ্য করতে ডোমেন নামক ইঞ্জিনিয়ারড প্রোটিন ব্যবহার করে। এই প্রোটিনগুলোকে বিশেষ ডিএনএ সিকোয়েন্স চিহ্নিত করতে এবং সংযুক্ত করতে গঠন করা হয়েছে।

জিঙ্ক ফিঙ্গার নিউক্লিয়াস গুলো সুনির্দিষ্ট অবস্থানে একটি এনজাইমের সাহায্যে ডিএনএ কেটে বিচ্ছিন্ন করে। এটি একটি ডিএনএ এর জেনেটিক উপাদান বিচ্ছিন্ন করা, সংযোজন করা কিংবা প্রতিস্থাপন করার জন্য ব্যবহার করা হয়। নতুন জিন সম্পাদনা করার ক্ষেত্রে, CRISPR-Cas9 এর কার্যপদ্ধতি থেকে Zinc Finger Nucleus পদ্ধতিটি বেশি জটিল।

ট্রান্সক্রিপশন অ্যাক্টিভেটর-লাইক ইফেক্টর নিউক্লিয়াস (TALENs)

Transcription Activator-Like Effector Nucleases (TALENs) মূলত একটি জিনোম সম্পাদনা সরঞ্জাম। এটি জিঙ্ক ফিঙ্গার নিউক্লিয়াস (ZFNs) এর মতই কিন্তু নির্দিষ্ট সিকোয়েন্স টার্গেট করার জন্য আলাদা ডিএনএ-বাইন্ডিং ডোমেন ব্যবহার করে। এছাড়াও এটি ব্যাকটেরিয়া থেকে উদ্ভূত TAL ইফেক্টর নামক প্রকৌশলী প্রোটিন ব্যবহার করে।

এই প্রোটিন গুলোকে TAL ইফেক্টরের অ্যামিনো অ্যাসিডের উপর ভিত্তি করে একটি কোডের মাধ্যমে নির্দিষ্ট ডিএনএ সিকোয়েন্সে আবদ্ধ করার জন্য সাজানো যায়। ZFN পদ্ধতির থেকে আরো সুবিধাজনক বিকল্প মাধ্যম হিসেবে TALENs পদ্ধতি তৈরি করা হয়েছে। এটি একটি ডিএনএকে সুনির্দিষ্ট ভাবে সাজাতে, জিন অপসারণ করতে, জিনের গঠন পরিবর্তন করতে সহায়তা করে।  

জিন থেরাপি

এই পদ্ধতিতে, নির্দিষ্ট কোন রোগের চিকিৎসা কিংবা রোগ প্রতিরোধের ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে রোগীর কোষে জিন প্রবেশ করানো হয়। এটি নির্দিষ্ট এবং লক্ষযুক্ত কোষে সরাসরি ডিএনএ ইনজেকশনের মাধ্যমে প্রবেশ করানো হয়। ভিন্নভাবে, পছন্দমতো জেনেটিক উপাদান সরবরাহ করতে ভাইরাসের মতো ভেক্টর ব্যবহার করেও জিন থেরাপি কার্যক্রম সম্পন্ন করা যায়। জীন থেরাপির মূল লক্ষ্য হলো জেনেটিক ভুলগুলো সংশোধন করা বা থেরাপিউটিক সুবিধা প্রদান করা।

সিন্থেটিক বায়োলজি

নতুন কোন জৈবিক অংশ গঠন কিংবা প্রয়োজন অনুসারে বিদ্যমান জৈবিক উপাদানগুলোকে পুনরায় সাজানোর জন্য সিন্থেটিক বায়োলজি ব্যবহার করা হয়। এর মাধ্যমে নতুন জৈবিক ফাংশন তৈরি করতে জেনেটিক উপাদানগুলোকে একত্রিত করে ঔষধ, শক্তি উৎপাদন, পদার্থবিজ্ঞানে প্রয়োগ ইত্যাদি কাজ করা হয়।

উপরোক্ত প্রতিটি জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং কৌশলীরই নির্দিষ্ট শক্তি এবং সীমাবদ্ধতা রয়েছে। তবে সবগুলো উপাদান একত্রিতভাবে আমাদের জিনগত প্রকৌশলীর অগ্রগতি নিশ্চিত করেছে।

জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং কিভাবে মানুষকে সহায়তা দিচ্ছে | জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং ব্যবহার ও প্রয়োজনীয়তা 

বর্তমানে জীব ও উদ্ভিদের বহু ক্ষেত্রসমূহে জিনতত্ত্ব প্রকৌশলী ওতপ্রোতভাবে ভাবে জড়িয়ে গেছে। আমরা প্রতিদিনই বিভিন্ন কাজে এই প্রযুক্তিটি ব্যবহার করে থাকি। নিচে Genetic Engineering -এর গুরুত্বপূর্ণ প্রয়োগিক ক্ষেত্রসমূহ তুলে ধরা হলো:

  • কৃষি ক্ষেত্রে ফসলের উন্নয়নের জন্য উদ্ভিদের প্রতিরোধ ক্ষমতা, পুষ্টি এবং হার্বিসাইড সহনশীলতা বাড়ায়।
  • জিন সংশোধন ও প্রতিস্থাপনের মাধ্যমে জেনেটিক রোগ-ব্যাধির চিকিৎসা করা হয়।
  • ফার্মাসিউটিক্যালস এর বিভিন্ন উদ্ভাবনে, যেমন: ওষুধ, ভ্যাকসিন এবং থেরাপিউটিক প্রোটিনের জন্য GMO ব্যবহার করা হয়।
  • রোগ এবং প্রক্রিয়া সম্পর্কে গবেষণা এবং বিশ্লেষনের জন্য পরিবর্তিত মডেল জীব বা উদ্ভিদ তৈরি করা যায়।
  • পরিবেশে GMO ব্যবহার করে দূষণকারী উপাদানগুলোকে বায়োরিমিডিয়েশনের মাধ্যমে পরিষ্কার করা যায়।
  • ফসলের ক্ষতি হ্রাস করতে দীর্ঘ সময় ফসল বা খাদ্য সংরক্ষণের জন্যও জিনতত্ত্ব প্রকৌশলী গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলে।
  • গবাদিপশুর মাংস বা দুধ উৎপাদনের জন্য প্রাণীদের মধ্যে উন্নত বৈশিষ্ট্য বৃদ্ধি করা যায়।
  • জেনেটিক কৌশল ব্যবহার করে বিপন্ন প্রজাতিকে রক্ষা এবং পুনরুদ্ধার করা যায়।
  • বিভিন্ন উদ্ভিদের বৃদ্ধি দ্রুতগতির করতে এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধিতেও জেনেটিক কৌশলগুলো প্রভাব ফেলে।
  • বিভিন্ন জটিল রোগের ক্ষেত্রে পরিবর্তিত জীব ব্যবহার করে কার্যকর ভ্যাকসিন উৎপাদন করা যায়।
  • উদ্ভিদ বা প্রাণীর দেহে নির্দিষ্ট লক্ষ্য যুক্ত কোষে পরিবর্তিত ডিএনএ স্থানান্তর করে লক্ষ্য যুক্ত ঔষধ পৌঁছানো যায়।
  • কীটনাশক ব্যবহার হ্রাস করে নির্দিষ্ট কীটপতঙ্গ প্রতিরোধী ফসল তৈরি করা যায়।
  • বিভিন্ন মাছের জাত উন্নত এবং অধিক উৎপাদনশীল করতে, বৃদ্ধি দ্রুতগতির করতে বা রোগ প্রতিরোধের জন্য পরিবর্তিত মাছ তৈরি করা যায়।
  • মানবদেহের বা অন্যান্য জীবের কোন ক্ষতিগ্রস্ত অঙ্গ পরিবর্তনের জন্য জেনোট্রান্সপ্লান্টেশন পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়।
  • বর্তমানে অন্ধত্ব প্রতিরোধে ভিটামিন এ দিয়ে চাল তৈরি করেছে।
  • এর মাধ্যমে ইনসুলিন, হিউম্যান গ্রোথ হরমোন এবং ভ্যাক্সিন তৈরি করা হয়।
  • টিস্যু ইঞ্জিনিয়ারিং করতে, কৃত্রিম অঙ্গ এবং টিস্যুর জন্য জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং ব্যবহার করা হয়।

এছাড়াও প্রতিনিয়ত জেনেটিক প্রকৌশলী ব্যবহার করার নতুন নতুন ক্ষেত্র উন্মোচিত হচ্ছে।

জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং এর সুবিধা ও অসুবিধা

জিনতত্ত্ব প্রকৌশলের প্রতিটি উপাদান ব্যবহারের মাধ্যমেই মানুষ নানাভাবে উপকৃত হচ্ছে। এটি নানা রকম আধুনিক ও প্রযুক্তিগত উপযোগিতার মাধ্যমে মানুষকে নানান সুবিধা দিচ্ছে। পাশাপাশি আর কিছু অপকারিতাও রয়েছে। নিচে জিনতত্ত্ব প্রকৌশলের সুবিধা ও অসুবিধা সমূহ তুলে ধরা হলো:

জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং এর সুবিধা

  • জিনতত্ত্ব প্রকৌশল রোগ প্রতিরোধের উন্নতি করতে সহায়তা করে।
  • অল্প বয়স্ক ও অনাগত শিশুদের নানান অসুস্থতা থেকে মুক্তি পেতে সহায়তা করে।
  • এটি কৃষিক্ষেত্রকে সম্ভাবনাময় করে তুলেছে এবং নতুন খাবার উৎপাদনে বড় ভূমিকা রাখছে।
  • উদ্ভিদে কীটপতঙ্গ প্রতিরোধের জন্য জেনেটিক স্তর তৈরি করতে সহায়তা করে।
  • এটি পশু কৃষি, পরিবেশ সংরক্ষণ, বনায়ন বর্ধন, জৈব নিরাপত্তা ব্যবস্থা, টেক্সটাইল শিল্প উদ্ভাবনে সহায়তা করে।
  • বায়োইনফরমেটিক্স বিশ্লেষণ, জৈব রাসায়নিক উৎপাদনের উন্নতি, জলজ চাষের অগ্রগতি, কৃত্রিম অঙ্গ ও টিস্যু সৃষ্টি এবং প্রতিস্থাপন।
  • জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং আমাদের ওষুধ গবেষণামূলক কাজকে উন্নত করে ইত্যাদি।

জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং এর অসুবিধা

  • জেনেটিক প্রকৌশলী নিয়ে গবেষণায় দেখা গেছে যে, একটি ইঁদুরকে জিনগতভাবে পরিবর্তিত খাবার দেওয়ার পর, সেই খাবার গ্রহণে তার লিভার এবং কিডনির সমস্যার ঝুঁকি সৃষ্টি হয়। এই সমস্যাগুলো মানবদেহের ক্ষেত্রেও প্রভাব ফেলবে কিনা নিশ্চিত নয়, তবে এটি ঝুঁকিপূর্ণ। 
  • GMO পদ্ধতিতে পরীক্ষার সময়সীমা মাত্র ৯০ দিন। এই সংক্ষিপ্ত সময়ে কাল সকল ঝুঁকি সনাক্ত করার জন্য যথেষ্ট নয়।
  • ট্রান্সজেনিক পরিবর্তনের ফলে একটি জীবের অপ্রাকৃতিক প্রজাতি উৎপন্ন হয়, যা পৃথিবীর মৌলিক নীতি-আদর্শ বিরোধী উদ্ভাবন।
  • GMO গুলো অপ্রত্যাশিতভাবে অ্যালার্জিযুক্ত ব্যক্তিদের প্রভাবিত করতে পারে।
  • কীটনাশক ব্যবহারের পরিমাণ কমানোর জন্য GMO প্রয়োগ করা হলেও, আগাছা এবং ব্যাকটেরিয়া কীটনাশক প্রতিরোধী হয়ে ওঠার ফলে কীটনাশকের ব্যবহার পুনরায় বৃদ্ধি পায় এবং ফসলের নিরাপত্তাকে প্রভাবিত করে।
  • অধিকাংশ ক্ষেত্রে GMO পণ্যগুলো লেবেলযুক্ত হয় না, ফলের এর সঠিক ব্যবহারিক সীমাবদ্ধতা জানা যায় না।
  • GMO গবেষণা ও পরীক্ষা-নিরীক্ষার ক্ষেত্রে প্রাণীদের উপর গবেষণা করা হয়। এতে নৈতিকভাবে প্রাণীর অধিকার লঙ্ঘন হয়।

সর্বোপরি, উপরোক্ত অসুবিধা বা অপকারিতা গুলো থাকলেও জেনেটিক প্রকৌশলী আধুনিক বিশ্বে ব্যাপক প্রভাব ফেলছে।

বায়োইনফরমেটিক্স ও জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং এর মধ্যে পার্থক্য

বায়োইনফরমেটিক্স এবং জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং উভয়ই জীববিজ্ঞানের গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র। উভয় ক্ষেত্রগুলোই একে অপরের পরিপূরক। বায়োইনফরমেটিক্স জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং প্রচেষ্টার জন্য গুরুত্বপূর্ণ সরঞ্জাম এবং গবেষণামূলক তথ্য প্রদান করে। এই এই দুটি ক্ষেত্রের মৌলিক পার্থক্য গুলো তুলে ধরা হলো:

জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং বায়োইনফরমেটিক্স
জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং জীবের মধ্যে নির্দিষ্ট ফলাফল অর্জনের জন্য জিন এবং অন্যান্য জেনেটিক উপাদানগুলির সরাসরি ম্যানিপুলেশন করে।বায়োইনফরমেটিক্স জৈবিক তথ্যের গণনামূলক বিশ্লেষণ এবং ব্যাখ্যা করতে কাজ করে।
এটি রিকম্বিন্যান্ট ডিএনএ প্রযুক্তি, CRISPR-Cas9, এবং জিন সম্পাদনা সরঞ্জাম ব্যবহার করে জিন পরিবর্তন করে বা বিভিন্ন জীবের মধ্যে জেনেটিক উপাদান স্থানান্তর করে।এটি কম্পিউটার অ্যালগরিদম, পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ এবং ডাটাবেস ব্যবহার করে জৈবিক ডেটা সংগঠন ও বিশ্লেষণ করে। মূলত এটি জেনেটিক তথ্য প্রক্রিয়া ও বিশ্লেষণ করার জন্য সফ্টওয়্যার বিকাশ করে।
জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং ওষুধ, কৃষি এবং শিল্পে বিভিন্ন প্রকার উদ্ভাবন করে।  এটি জিনগতভাবে পরিবর্তিত জীব (GMOs) তৈরি করতে, রোগ-প্রতিরোধী ফসল বিকাশ করতে, রিকম্বিন্যান্ট ডিএনএ প্রযুক্তির মাধ্যমে ফার্মাসিউটিক্যালস উৎপাদন করতে এবং মানুষের মধ্যে সম্ভাব্য জেনেটিক রোগগুলোর চিকিৎসা করতে ব্যবহৃত হয়।বায়োইনফরমেটিক্স জিনোমিক্স, প্রোটিওমিক্স, বিবর্তনীয় জীববিজ্ঞান এবং ওষুধ আবিষ্কার সহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে অবদান রাখে। এটি জিন শনাক্ত করতে, প্রজাতির মধ্যে বিবর্তনীয় সম্পর্ক অন্বেষণে সহায়তা করে।

বাংলাদেশে জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং শিক্ষা ব্যবস্থা

বাংলাদেশের আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থায় বায়োটেকনোলজি বিষয়ে শিক্ষা প্রদান শুরু হয় ১৯৯৫ সালে। তখন খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় ‘Bsc in Biotechnology’ প্রোগ্রাম চালুর মাধ্যমেই এর যাত্রা শুরু হয়েছিল। পরবর্তীকালে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় গুলোতে ২০০৩ সালে ‘বায়োটেকনোলজি অ্যান্ড জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং’ নামে প্রোগ্রামটি চালু করা হয়। বর্তমানে এটি বিভিন্ন নামে দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্য বিষয় হিসেবে পড়ানো হচ্ছে।

 এই প্রোগ্রামের আওতায় একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীকে জীববিজ্ঞানের বিভিন্ন উচ্চতর বিষয় সম্পর্কে শিক্ষা প্রদান করা হয়। যেমন:

  • রিকম্বিনেন্ট ডিএনএ টেকনোলজি, 
  • জিন থেরাপি, 
  • জেনোম সিকুয়েন্সিং, 
  • ডেভেলপমেন্ট বায়োলজি,
  • অ্যানিমেল সেল কালচার, 
  • প্ল্যান্ট টিস্যু কালচার, 
  • ডিএনএ ফিঙ্গারপ্রিন্টিং, 
  • স্টেম সেল থেরাপি,
  • রিজেনারেটিভ মেডিসিন,
  • ভ্যাকসিন ডেভেলপমেন্ট
  • ন্যানোটেকনোলজি,
  • এবং ক্যানসার বায়োলজি। 

এছাড়াও পিসিআর, এনএমআর, আরটিপিসিআর, ফ্লো সাইটোমেট্রির, স্পেকট্রসকপি, মাইক্রোঅ্যারে ইত্যাদি বিশেষায়িত প্রযুক্তি সম্পর্কে শিক্ষা প্রদান করা হয়।

বায়োটেকনোলজি অ্যান্ড জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং ক্যারিয়ার

বায়োটেকনোলজি অ্যান্ড জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিশ্বব্যাপী একটি অত্যাধুনিক এবং যুগোপযোগী প্রোগ্রাম হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। দেশের উচ্চ শিক্ষা ব্যবস্থায় জেনেটিক প্রকৌশলকে বিশেষভাবে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। কারণ, আধুনিক বাংলাদেশ গড়তে, এই বিষয়ে দক্ষ গবেষকদের গুরুত্ব অপরিসীম।

বাংলাদেশের সরকারি, বেসরকারি এবং স্বায়ত্তশাসিত বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানে বায়োটেকনোলজি বিষয়ে স্নাতক বা স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারীদের (Graduates) কর্মসংস্থানের সুযোগ রয়েছে। এছাড়াও আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ফরেনসিক বিভাগ, ফুড অ্যান্ড বেভারেজ ইন্ডাস্ট্রি, বায়োটেকনোলজি বেইজড ইন্ডাস্ট্রি গুলোতে উচ্চশিক্ষিতদের কর্মসংস্থানের সুযোগ রয়েছে। 

আরো পড়ুন: বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট এর সামগ্রিক তথ্য ও সাধারণ জ্ঞান

বিভিন্ন ফার্মাসিউটিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিতেও বায়োটেকনোলজি ও জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়ে গ্রাজ্যুয়েটদের কর্মসংস্থানের সুযোগ রয়েছে। তাছাড়া বায়োটেকনোলজির বিভিন্ন বিষয় নিয়ে উচ্চশিক্ষা অর্জন করে নিজেকে একজন উদ্যোক্তা হিসেবেও প্রতিষ্ঠিত করা সম্ভব। 

শেষকথা 

জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং পৃথিবীর মানুষের বুদ্ধিমত্তা, কৌতূহল এবং বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের নিরলস সাধনার প্রমাণ। এটি ক্রমাগত বিকশিত হওয়ার সাথে সাথে আমাদের জীবন, স্বাস্থ্য এবং পরিবেশের উপর ব্যাপকভাবে প্রভাব ফেলছে। আশা করা হয়, ভবিষ্যতে এটি সমগ্র জৈবপ্রযুক্তি এবং সমাজের রূপক নতুনভাবে সাজাবে।

Scroll to Top