ভারতীয় উপমহাদেশে বহু শাসনব্যবস্থা পরিচালিত হয়েছিল। তন্মধ্যে অন্যতম শক্তিশালী মুঘল সাম্রাজ্যের শাসকরা গড়ে তুলেছিল ভারত উপমহাদেশের একটি ঐতিহাসিক সাম্রাজ্য। ১৫২৬ সাল থেকে ১৮৫৭ সাল পর্যন্ত বিরাজমান থাকা এই সাম্রাজ্যে ধারাবাহিকভাবে সম্রাট বাবরের বংশধরেরা পাল্টে দিয়েছে ভারতীয় উপমহাদেশের সমাজব্যবস্থা, সংস্কৃতি, অর্থনীতি, শিক্ষা, অবকাঠামো ইত্যাদি। এই সাম্রাজ্যই আমাদের উপহার দিয়েছে তাজমহলের মতো বিশ্ব-আশ্চর্য স্থাপনা। আমাদের ভারতীয় উপমহাদেশে এই মুঘল শাসনামলের প্রভাব, মুঘল সাম্রাজ্যের ইতিহাস, বংশতালিকা ও পতনের কারন সম্পর্কে তুলে ধরা হলো এই লেখাতে।
ভারত উপমহাদেশে মুঘল শাসনামলের প্রভাব
দক্ষিণ এশিয়ার শিল্প ও সংস্কৃতির উন্নয়নে মুঘলরা অন্যতম অগ্রগামী ভূমিকা পালন করেছিল। সম্রাট বাবরের প্রতিষ্ঠার পর থেকে এই সাম্রাজ্য ব্যাপক প্রসার ও উন্নয়নের মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী অনন্য কীর্তির নিদর্শন রেখে গেছে। মুঘল শাসনকালে ভারতীয় উপমহাদেশে নান্দ্যনিক স্থাপত্য, ভাষা, সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য, উন্নত সমাজ ব্যবস্থা, সমৃদ্ধশালী অর্থনীতি, সামরিক ও রাজনৈতিক কেন্দ্র, উৎপাদন বা বাণিজ্যিক কেন্দ্র, শিল্প, আইন, ইসলাম ধর্মের প্রসার, নানান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, আলকেমি, জ্যোতির্বিজ্ঞান ইত্যাদিতে ব্যাপক উন্নয়ন সাধিত হয়।
তখন নির্মান করা মুঘল স্থাপত্যের বহু নিদর্শন ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ, আফগানিস্তানের অনেক অঞ্চল যেমন আগ্রা, আওরঙ্গবাদ, দিল্লি, ঢাকা, ফতেহপুর সিক্রি, জয়পুর, লাহোর, কাবুল, শেখপুরে ছড়িয়ে রয়েছে। মুঘল সাম্রাজ্যের অংশসমূহ বর্তমানে বিভিন্ন রাষ্ট্রে বিভক্ত হলেও বহু কর্মকান্ড ও রীতিনীতিতে মুঘল স্থাপত্যের প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। উর্দু ভাষার প্রসার হয় এই সময়ে। মুঘলদের সমাজব্যবস্থা, অবকাঠামো নির্মান, কাপড়, আসবাবপত্র ও বিভিন্ন প্রকার শিল্পের উন্নয়ন ও প্রসার হয়েছিল এই সময়ে। মুঘলদের শিক্ষাব্যবস্থাও ছিল তৎকালীন সময়ের জন্য উন্নত। মুঘলরা প্রত্যেক প্রদেশে মক্তব গড়ে তুলেছিল, যেখানে কুরআন ও ইসলামি আইন শিক্ষা দেয়া হতো।
সব মিলিয়ে ভারত উপমহাদেশে মুঘল শাসনামলের ব্যাপক প্রভাব রয়েছে, যা সংক্ষিপ্তভাবে ব্যক্ত করা সম্ভব নয়।
মুঘল সাম্রাজ্যের ধারাবাহিক ইতিহাস | মুঘল সম্রাটদের বংশ তালিকা
সম্রাট বাবর (১৫২৬-১৫৩০)
মধ্যযুগে মধ্য এশিয়ার তুর্কো-মঙ্গোল বংশোদ্ভূত শাসক সম্রাট বাবর (জহিরউদ্দিন মুহাম্মদ) এই মুঘল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা করেন। মধ্য এশিয়া থেকে বিতাড়িত হয়ে তিনি ভারতীয় সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠায় নিয়োজিত হন। যাত্রার প্রথমে তিনি নিজেকে কাবুলের শাসক হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেন এবং আফগানিস্তান থেকে খাইবার পাস হয়ে ভারতে প্রবেশ করেছিলেন। সম্রাট বাবর তার বাবার দিক থেকে তৈমুর লং ও মায়ের দিক থেকে চেঙ্গিস খানের বংশধর ছিলেন।
তিনি সামগ্রিকভাবে সমগ্র ভারতের ব্যাপক উন্নয়ন সাধন করেছিলেন। সম্রাট বাবরের সেনাবাহিনীরা পানিপথের যুদ্ধে বিজয়ের পর উত্তর ভারতের অধিকাংশ এলাকা জয় করে নেয়। তারপর দীর্ঘ সময় ব্যয় করর শাসন পাকাপোক্ত করে নেয়। সম্রাট বাবরের শাসনকাল ছিল ৩০ এপ্রিল ১৫২৬ থেকে ২৬ ডিসেম্বর ১৫৩০ পর্যন্ত।
সম্রাট হুমায়ুন (নাসিরউদ্দিন মুহাম্মদ হুমায়ুন, (১৫৩০-১৫৫৬)
সম্রাট বাবরের শাসনকাল শেষে তার ছেলে সম্রাট হুমায়ুন সিংহাসনের দায়িত্ব নেন। সম্রাট বাবরের ছেলে হুমায়ুনের সময়ে অস্থিতিশীলতা ছড়িয়ে পড়ে। কারন তৎকালীন দিগ্বিজয়ী সেনাপতি শেরশাহ কর্তৃক হুমায়ুন ক্ষমতাচ্যুত হয়। এমতাবস্থায় হুমায়ুন ভারত থেকে পারস্যে পালিয়ে যায়। সেখানে পারস্যের সাফাভিদের সাথে হুমায়ুনের কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপিত হয় এবং সাফাভিদের সহায়তায় হুমায়ুন ভারতে মুঘলদের ক্ষমতা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেন। হুমায়ুনের সাথে পারস্যের সাফাভিদের সুসম্পর্ক প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে মুঘল সাম্রাজ্যে পারসীয় সাংস্কৃতিক প্রভাব বৃদ্ধি পেতে থাকে।
সম্রাটের দায়িত্ব পালনকালীন অবস্থায় নিজস্ব গ্রন্থাগারে ঘটা এক দুর্ঘটনায় হুমায়ুনের মৃত্যু হয়। সম্রাট হুমায়ুনের শাসনকাল ছিল ২৬ ডিসেম্বর ১৫৩০ থেকে ১৭ মে ১৫৪০ এবং পুনরায় ২২ ফেব্রুয়ারি ১৫৫৫ থেকে ২৭ জানুয়ারি ১৫৫৬ পর্যন্ত।
সম্রাট আকবর-এ-আজম (১৫৫৬-১৬০৫)
সম্রাট হুমায়ুন মৃত্যুবরণ করার পর তার ছেলে আকবর (জালালউদ্দিন মুহাম্মদ) অপ্রাপ্তবয়স্ক অবস্থায় সিংহাসনের দায়িত্ব পালন শুরু করেন। ১৫৫৬ সালে আকবরের ক্ষমতারোহণের মাধ্যমে মুঘল সাম্রাজ্যের ধ্রূপদী যুগ শুরু হয়। ভারতে মুঘল সাম্রাজ্যের ভিত্তি মজবুত করতে আকবরকে সহায়তা করেছিলেন তার অভিভাবক বৈরাম খান। আকবর তার সৃজনশীলতার মাধ্যমে ভারতের সামাজিক গোষ্ঠীর সামরিক অভিজাতদের থেকে তার প্রতি অনুগত নতুন অভিজাত শ্রেণী গড়ে তোলেন।
তিনি যুদ্ধ ও কূটনীতির মাধ্যমে তার সাম্রাজ্যকে সবদিকে প্রসারিত করতে থাকে। পাশাপাশি উন্নত সরকার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা ও সাংস্কৃতিক উন্নয়নে অবদান রেখেছিলেন তিনি। এছাড়াও তিনি ইউরোপীয় বাণিজ্য কোম্পানিগুলোর সাথে বাণিজ্য সম্প্রসারিত করেছেন। সম্রাট আকবরের শাসনকাল ছিল ২৭ জানুয়ারি ১৫৫৬ থেকে ২৭ অক্টোবর ১৬০৫ পর্যন্ত।
সম্রাট জাহাঙ্গীর (১৬০৫-১৬২৭)
আকবরের পর শাসনব্যবস্থার দায়িত্ব পালন করেছিলেন তার ছেলে সম্রাট জাহাঙ্গীর (নুরউদ্দিন মুহাম্মদ সেলিম)। সম্রাট আকবর ও তার ছেলে জাহাঙ্গীরের শাসনামলে ভারতে অর্থনৈতিক প্রগতি বহুদূর অগ্রসর হয়। সম্রাট জাহাঙ্গীর সমৃদ্ধির সাথে শাসন করেছেন, তবে তার সবচেয়ে বড় দূর্বলতা ছিল যে, তিনি মাদকাসক্ত ছিলেন। সম্রাট জাহাঙ্গীরের রাষ্ট্রীয় কর্মকান্ডে দায়সারা ভাব দেখে দরবারের প্রভাবশালীরা তার সন্তান খুররম ও শাহরিয়ারের পক্ষ নিয়ে ২ দলে বিভক্ত হয়ে বিদ্রোহ করে। সম্রাট জাহাঙ্গীর সেই বিদ্রোহীদের প্রভাবে পড়ে সিংহাসন ত্যাগ করতে বাধ্য হন। সম্রাট জাহাঙ্গীরের শাসনকাল ছিল ১৫ অক্টোবর ১৬০৫ থেকে ৮ নভেম্বর ১৬২৭ পর্যন্ত।
সম্রাট শাহজাহান-এ-আজম (১৬২৭-১৬৫৮)
সম্রাট জাহাঙ্গীর বিদ্রোহীদের প্রভাবে পড়ে সিংহাসন ত্যাগ করার পর, তার ছেলে খুররম শাহজাহান (শাহাবউদিন মুহাম্মদ খুররম) হিসেবে মুঘল সিংহাসনে আরোহণ করেন। সম্রাট শাহজাহানের শাসনামলে মুঘল সাম্রাজ্য জাকজমকপূর্নতা ও বিলাসিতার জন্য প্রসিদ্ধ হতে থাকে।
এসময় তাজমহলের মতো বহু বিলাসবহুল ইমারত নির্মিত হয়, যা ভারতের শোভাবর্ধন করেছে বিশ্বব্যাপী। কিন্তু তখনও দরবারের রক্ষণাবেক্ষণের খরচ রাজস্ব আয়ের চেয়ে বেশি ছিল, যা সাধারন মানুষের জন্য সুবিধাজনক ছিল না। সম্রাট শাহজাহানের শাসনকাল ছিল ৮ নভেম্বর ১৬২৭ থেকে ২ আগস্ট ১৬৫৮ পর্যন্ত। সম্রাট শাহজাহান বৃদ্ধ অবস্থায় অসুস্থ হয়ে পড়লে তার বড় ছেলে ‘দারা শিকোহ’ সিংহাসনের উত্তরাধিকারী হয়েছিল। কিন্তু সেই সময় সিংহাসন নিয়ে শাহজাহানের ছেলেদের মাঝে প্রতিদ্বন্দ্বিতা দেখা দেয়।
সম্রাট আলমগীর/ আওরঙ্গজেব (১৬৫৮-১৭০৭)
সম্রাট শাহজাহানের ছেলেদের মাঝে সিংহাসন নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা দেখা দিলে, অবশেষে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অন্যান্যদের পরাজিত করতে সক্ষম হয়েছিলেন সম্রাট আওরঙ্গজেব। কিন্তু পারিবারিক বিদ্রোহের এক পর্যায়ে সম্রাট আওরঙ্গজেবের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে প্রভাব বিস্তার করায় তার পিতা শাহজাহানকে গভীর অসুস্থতা সত্ত্বেও গৃহবন্দী করেন। পাশাপাশি তিনি কোন এক কারনবশত দারা শিকোহকে মৃত্যুদণ্ড দেয়। সম্রাট আওরঙ্গজেবের সময়কালে মুঘল সাম্রাজ্যের রাজনৈতিক পরিধি প্রায় সমগ্র দক্ষিণ এশিয়াজুড়ে সম্প্রসারিত হয়। সম্রাট শাহজাহানের শাসনকাল ছিল ৩১ জুলাই ১৬৫৮ থেকে ৩ মার্চ ১৭০৭ পর্যন্ত।
সম্রাট আজম (১৭০৭-১৭০৭)
১৭০৭ সালে সম্রাট আওরঙ্গজেবের মৃত্যুর পর সাম্রাজ্যের বিভিন্ন অংশে বিদ্রোহ শুরু হয়। এসময় সিংহাসনের দায়িত্ব পালন করেছেন সম্রাট আজম শাহ (আবুল ফাইজ কুতুবউদ্দিন মুহাম্মদ আজম)। তিনি ১৪ মার্চ ১৭০৭ থেকে ৮ জুন ১৭০৭ পর্যন্ত মাত্র কয়েক মাস মুঘল সাম্রাজ্যের শাসন কার্য পরিচালনা করতে সক্ষম হয়েছিলেন।
সম্রাট প্রথম বাহাদুর শাহ (১৭০৭-১৭১২)
সম্রাট আজম মুঘল সাম্রাজ্যের সম্রাটের দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হওয়ায় আওরঙ্গজেবের ছেলে প্রথম বাহাদুর শাহ (কুতুবউদ্দিন মুহাম্মদ মুয়াজ্জম) প্রশাসন সংস্কার করতে চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু ১৭১২ সালে তিনিও মৃত্যুবরন করলে মুঘল সাম্রাজ্য বিশৃঙ্খল হয়ে পড়ে। তার শাসনকাল ছিল ১৯ জুন ১৭০৭ থেকে ২৭ ফেব্রুয়ারি ১৭১২ পর্যন্ত।
সম্রাট জাহানদার শাহ (১৭১২-১৭১৩)
সম্রাট আজমের মৃত্যুর পর জাহানদার শাহ (মাআজউদ্দিন জাহানদার শাহ) মুঘল সাম্রাজ্যের দায়িত্বভার নিয়েছিলেন। কিন্তু তৎকালীন সময়ে নানারকম বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হওয়ায় তিনি দীর্ঘদিন সিংহাসনে স্থায়ী থাকতে পারেননি। তার শাসন কার্য ছিল ২৭ ফেব্রুয়ারি ১৭১২ থেকে ১১ ফেব্রুয়ারি ১৭১৩ পর্যন্ত। অতঃপর ১৭১৯ সালের দিকে ৪ জন দুর্বল সম্রাট পরপর শাসনব্যবস্থা পরিচালনা করেছেন। কিন্তু সেই শাসনব্যবস্থা তেমন ফলপ্রসূ ছিল না। এই চারজন দুর্বল সম্রাট ছিলেন যথাক্রমে-
- সম্রাট ফররুখসিয়ার (১১ জানুয়ারি ১৭১৩ থেকে ২৮ ফেব্রুয়ারি ১৭১৯ পর্যন্ত)।
- সম্রাট রাফি উল-দারজাত (২৮ ফেব্রুয়ারি ১৭১৯ থেকে ৬ জুন ১৭১৯ পর্যন্ত)।
- সম্রাট দ্বিতীয় শাহজাহান/ রাফি উদ-দৌলত (৬ জুন ১৭১৯ থেকে ১৯ সেপ্টেম্বর ১৭১৯ পর্যন্ত)।
- সম্রাট মুহাম্মদ শাহ/ রোশান আখতার বাহাদুর (২৭ সেপ্টেম্বর ১৭১৯ থেকে ২৬ এপ্রিল ১৭৪৮ পর্যন্ত)।
সম্রাট মুহাম্মদ শাহ (১৭১৯-১৭৪৮)
১৭১৯ সালে যখন মুঘল সাম্রাজ্যের শাসন ব্যবস্থা বারবার ভেঙে পড়েছিল তখন সম্রাট মুহাম্মদ শাহ এর শাসনকাল অনেকটাই দীর্ঘস্থায়ী হয়েছিল। এ সময় মুঘল সাম্রাজ্যের তেমন প্রসার না হলেও, একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়া প্রচলিত হচ্ছিল এবং সবকিছুই যেন সাধারণভাবে চলছিল। কিন্তু মুহাম্মদ শাহের শাসনামলের শেষের দিকে মুঘল সাম্রাজ্য ভেঙে পড়তে থাকে এবং মধ্য ভারতের অধিকাংশ স্থান মারাঠা সাম্রাজ্যের হাতে ন্যাস্ত হয়৷ ১৭৪৮ সালের দিকে এই শাসনব্যবস্থা মুহাম্মদ শাহের হাত থেকে ক্ষুন্ন হয়।
এই সময়ে নাদির শাহ দিল্লিতে আক্রমন করে মুঘল শক্তিকে আরও দূর্বল করে তোলে। তখন মুঘল সাম্রাজ্যে বহু স্বাধীন রাজ্যের উদ্ভব হয়, যদিও তখন মুঘল সম্রাটকে সর্বোচ্চ শাসক হিসেবে বিবেচনা করা হতো। এ সময় আরো ৩ জন শাসক মুঘল শাসন ব্যবস্থা পরিচালনা করেছিলেন। তারা ছিল:
- সম্রাট আহমেদ শাহ বাহাদুর (২৬ এপ্রিল ১৭৪৮ থেকে ২ জুন ১৭৫৪ পর্যন্ত)।
- সম্রাট দ্বিতীয় আলমগীর/ আজিজউদ্দিন (২ জুন ১৭৫৪ থেকে ২৯ নভেম্বর ১৭৫৯ পর্যন্ত)।
- তৃতীয় শাহজাহান/ মুহিউল মিল্লাত (১০ ডিসেম্বর ১৭৫৯ থেকে ১০ অক্টোবর ১৭৬০ পর্যন্ত)।
সম্রাট দ্বিতীয় শাহ আলম (১৭৫৯-১৮০৬)
সম্রাট দ্বিতীয় শাহ আলম (আলি গওহর) মুঘল সাম্রাজ্যের কর্তৃত্ব পুনপ্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেছিলেন। জন্য আফগানিস্তানের আমির আহমেদ শাহ আবদালি ও অন্যান্য বাইরের শক্তিধরদের সহায়তা নেয়। ১৭৬১ সালে আফগান-মুঘল ও মারাঠা সাম্রাজ্যের মধ্যে পানিপথের তৃতীয় যুদ্ধ হয়। এই যুদ্ধে মারাঠারা পরাজিত হলেও ১৭৭১ সালে তারা পুনরায় দিল্লি দখল করে নেয়। ১৭৮৪ সাল থেকে ইঙ্গ-মারাঠা যুদ্ধের আগ পর্যন্ত মারাঠারা আনুষ্ঠানিকভাবে দিল্লিতে সম্রাটের রক্ষক হয়ে উঠেছিল। ২৪ ডিসেম্বর ১৭৫৯ থেকে ১৯ নভেম্বর ১৮০৬ সাল পর্যন্ত প্রায় ৪৭ বছর পর্যন্ত (৪৬ বছর ৩৩০ দিন) দ্বিতীয় শাহ আলম মুঘল সাম্রাজ্যের পরিচালনা করেছিলেন।
সম্রাট দ্বিতীয় আকবর শাহ (১৮০৬- ১৮৩৭)
সম্রাট দ্বিতীয় শাহ আলমের শাসনকার্য শেষ হওয়ার পর দ্বিতীয় আকবর শাহ (মির্জা আকবর) মুঘল শাসনব্যবস্থা পরিচালনার দায়িত্বে ন্যাস্ত হয়েছিলেন। যদিও এই সময় মুঘল শাসনব্যবস্থার তেমন প্রসার ছিল না। ধীরে ধীরে মুঘল শাসন ক্ষমতাচ্যুত ও দুর্বল হতে থাকে। সম্রাট দ্বিতীয় আকবর শাহ ১৯ নভেম্বর ১৮০৬ থেকে ২৮ সেপ্টেম্বর ১৮৩৭ পর্যন্ত সম্রাট ছিলেন।
সম্রাট দ্বিতীয় বাহাদুর শাহ (১৮৩৭-১৮৫৭)
ঐতিহাসিক তথ্যমতে মুঘল শাসনব্যবস্থার সর্বশেষ সম্রাট ছিলেন আবু জাফর সিরাজউদ্দিন মুহাম্মদ বাহাদুর শাহ জাফর। তার শাসনব্যবস্থায় তেমন ত্রুটি না থাকলেও, তখন মুঘল শাসনকালের পরিসমাপ্তি হতে শুরু করে। সম্রাট দ্বিতীয় বাহাদুর শাহ এর শাসনকাল ছিল ২৮ সেপ্টেম্বর ১৮৩৭ থেকে ১৪ সেপ্টেম্বর ১৮৫৭ পর্যন্ত। প্রায় ২০ বছর (১৯ বছর ৩৫১ দিন) তিনি শাসনকার্য পরিচালনার পর ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি মুঘল রাজবংশের রক্ষক হয়ে উঠে। অবশেষে সিপাহী বিদ্রোহে ব্যর্থ হওয়ার পর শেষ মুঘল সম্রাটকে ক্ষমতাচ্যুত করে নির্বাসনে পাঠানো হয় এবং ইংল্যান্ডের রাণী ভিক্টোরিয়াকে ভারত সম্রাজ্ঞী ঘোষণা করা হয়।
আরও পড়ুন: মিশরীয় সভ্যতার ইতিহাস
মুঘল সাম্রাজ্যের পতনের কারন
ভারতে প্রায় ৩৩১ বছরের দীর্ঘ মুসলিম শাসনব্যবস্থার অবসান ঘটে মুঘল শাসনব্যবস্থার পতনের মাধ্যমে। ১৮৫৭ সালে ইংল্যান্ডের দখলের মাধ্যমে মুঘলদের শাসন কার্যের অস্তিত্ব প্রায় বিলীন হয়ে পড়ে। ইতিহাসবিদরা মুঘল শাসনকালের পতনের বেশ কিছু কারণ উল্লেখ করেন। যেমন:
- তখন অর্থনৈতিক দিক থেকে সাম্রাজ্যে প্রধান কর্মচারী, আমিরদের বেতন দিতে প্রয়োজনীয় রাজস্ব ছিল না।
- এসময় আঞ্চলিক শাসকদের উপর সম্রাট নিজের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছিলেন।
- দীর্ঘদিন যাবত মারাঠাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চলমান থাকায় মুঘল সেনাবাহিনীরা মনোবল হারিয়ে ফেলে।
- ফররুখসিয়ারের মৃত্যুর পর স্থানীয় শাসকরা ক্ষমতা নিতে শুরু করে।
- অন্যদিকে, অসাধুতা, অত্যধিক বিলাসিতা এবং সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি শাসকদের বাহ্যিক হুমকির ব্যাপারে অপ্রস্তুত করে তোলে।
- ধনীদের হাতে কৃষকদের নিপীড়নের কারণে শাসনের প্রতি জনসমর্থন কমে যায়।
- সাম্রাজ্যের অত্যধিক সমৃদ্ধি প্রদেশগুলোকে অধিক মাত্রায় স্বাধীনতা অর্জনে উৎসাহ যোগিয়েছিল এবং রাজ দরবারকে দুর্বল করে তোলে।
ইত্যাদি বিভিন্ন কারণে শক্তিশালী মুঘলরা ধীরে ধীরে দুর্বল হতে থাকে।
শেষকথা
মুঘল সাম্রাজ্যের ইতিহাস বর্তমানে শুধু ঐতিহাসিক পটভূমি হয়ে থাকলেও, এটি ভারতীয় উপমহাদেশের সার্বিক উন্নয়নে ব্যাপক অবদান রেখে গেছে। বর্তমানেও সেই সময়কার সংস্কৃতি, অবকাঠামো ও সমাজব্যবস্থা ব্যবহৃত হচ্ছে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে।