শিল্প বিপ্লব কী? শিল্প বিপ্লবের ধারাবাহিক ইতিহাস

বর্তমানে আমরা উৎপাদন শিল্পের আধুনিক ব্যবস্থার যুগে বসবাস করছি। তবে পৃথিবীব্যাপী শিল্প খাতের এই উন্নয়ন সাধিত হয়েছে কয়েক শতাব্দী ধরে। ১৮ শতকের শিল্প বিপ্লব সম্পর্কে আমরা সকলেই কমবেশি জেনেছি। তবে সেই শিল্প বিপ্লবের বাস্তবিক ইতিহাস, তাৎপর্য, পটভূমি এবং বর্তমানে সেই উন্নয়নের প্রভাব সম্পর্কে সকলের মাঝে তথ্যভিত্তিক বিস্তার খুবই কম। তাই শিল্প বিপ্লব কি, শিল্প বিপ্লব কাকে বলে, কি কারনে সেই বৈপ্লবিক উন্নয়ন হয়েছিল, প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের ধারাবাহিক ইতিহাস ও শিল্প বিপ্লবের ফলাফল/ প্রভাব সম্পর্কে তুলে ধরা হলো এই লেখাতে।

শিল্প বিপ্লব কাকে বলে | শিল্প বিপ্লব কি? 

১৮ শতকের মাঝামাঝি সময়ে ইংল্যান্ড এবং ইউরোপের অন্যান্য দেশে বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তি ও যন্ত্রপাতিকে কাজে লাগিয়ে শিল্পের উৎপাদন ব্যবস্থায় যে অভূতপূর্ব পরিবর্তন ঘটেছিল, তা-ই শিল্প বিপ্লব নামে পরিচিত। পৃথিবীর সামগ্রিক উন্নয়নে সেই শিল্প বিপ্লবকালীন সময়ের ব্যাপক প্রভাব রয়েছে। 

ভিন্নভাবে বলতে গেলে, শিল্প বিপ্লব এমন এক সময়কাল ছিল, যখন অধিক দক্ষ এবং স্থিতিশীল উৎপাদন প্রক্রিয়ার দিকে মানবসভ্যতার অর্থনীতি বৈশ্বিকভাবে রূপান্তরিত হয়েছিল। এসময় উৎপাদন ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায় যার ফলে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার বাড়তে থাকে।

শিল্প বিপ্লব বলতে কী বোঝায়?

সাধারণভাবে বিপ্লব বলতে কোনো দেশের অভ্যন্তরীণ সংঘাতপূর্ন কর্মকাণ্ডকে বুঝানো হয়, যার মাধ্যমে সরকার, সংবিধান কিংবা একটি সমগ্র দেশের সমাজ ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন সাধিত হয়। শিল্প বিপ্লবকালীন সময়েও ঠিক সেভাবেই বিভিন্ন শিল্পকারখানার উদ্বোধন প্রক্রিয়া ব্যাপকহারে বৃদ্ধি পেয়েছিল বলে, সেই সময়টিকে শিল্প বিপ্লবকালীন সময় বলা হয়।

এই বিপ্লবকালীন সময়ের মধ্যেই, হাতের মাধ্যমে উৎপাদন পদ্ধতির পরিবর্তে মেশিনের ব্যবহার শুরু হয়। নতুন রাসায়নিক শিল্প এবং লৌহ উৎপাদন প্রক্রিয়ার উত্থান ঘটে। জল শক্তি এবং বাষ্প শক্তির ক্রমবর্ধমান ব্যবহার হতে থাকে এই সময়েই। বিপ্লবকালীন সময়ে মেশিন টুলস উন্নয়ন এবং যান্ত্রিক কারখানা ব্যবস্থার উত্থানও উল্লেখযোগ্য। 

তবে শিল্প খাতে ব্যাপক উন্নয়নের সময়ে এটিকে বৈপ্লবিক দৃষ্টিকোণ থেকে তুলনা করা হয়নি। ব্যাপক উন্নয়নমূলক এই সময়টিকে ১৮৩৭ সালে ফরাসি দার্শনিক লুই অগাস্তে ব্লাংকি সর্বপ্রথম ‘শিল্প বিপ্লব’ বলে ব্যবহার করেন। পরবর্তীকালে জন স্টুয়ার্ট মিল ও কাল মার্কস শিল্প বিপ্লব কথার প্রয়োগ করেন। ১৮৪৫ সালে জার্মান সমাজতন্ত্রী দার্শনিক ফ্রেডরিখ অ্যাঙ্গেলস আবার শিল্প বিপ্লব কথাটি ব্যবহার করেন। ১৮৮০-১৮৮১ সালে বিশিষ্ট ব্রিটিশ ঐতিহাসিক আর্নল্ড টয়েনবি শিল্প বিপ্লব কথাটিকে জনপ্রিয় করে তুলেছিলেন। তিনি তার “Lectures on the Industrial Revolution in England” গ্রন্থে শিল্প বিপ্লব (Industrial Revolution) ব্যবহার করেছিলেন।

শিল্প বিপ্লব কত সালে হয়?

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, গ্রেট ব্রিটেন এবং ইউরোপ মহাদেশে প্রায় ১৭৬০ থেকে ১৮৪০ সালের মধ্যবর্তী সময়ে কৃষি বিপ্লবের পর শিল্প বিপ্লব সংঘটিত হয়েছিল। বস্ত্র শিল্পে সর্বপ্রথম আধুনিক উৎপাদন পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়েছিল। তখন টেক্সটাইল খাতের কর্মসংস্থান, উৎপাদন মূল্য বৃদ্ধি এবং বিনিয়োগকৃত পুঁজির কারণে বস্ত্র শিল্প একটি প্রভাবশালী শিল্পে পরিণত হয়। ১৭৬০ সালে শিল্প বিপ্লবের মাধ্যমে শিল্পায়নের সূত্রপাত হয়। ১৭৮৪ সালে বাষ্পীয় ইঞ্জিন তৈরির মাধ্যমে এটি ব্যাপকভাবে প্রসার লাভ করে।

ইংল্যান্ডে শিল্প বিপ্লবের কারন

ইংল্যান্ডে শিল্প বিপ্লব সংঘটিত হওয়ার পেছনে বহু কারণ ও উপযোগিতা জড়িত রয়েছে। তবে এর মধ্যে অন্যতম বড় একটি কারণ ছিল পুঁজির জোগান বা পুঁজিবাদীতা। এ সময় উৎপাদনশিল্পে প্রসারের জন্য পুঁজির যোগান দেওয়া সহজ হয়ে উঠেছিল। মূলত পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত তখন ইংরেজদের রাজত্ব চলছিল। তাই পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের সম্রাটদের কাছ থেকে তাদের রাজ্যের সামগ্রিক মূলধন সংগ্রহ করতে পারছিল ইংল্যান্ড বাসীরা। তার আগেই পঞ্চদশ ও ষোড়শ শতাব্দীর সমুদ্র যাত্রা বিশ্বব্যাপী বাণিজ্যের পথ খুলে দিয়েছিল। 

তাছাড়া তৎকালীন সময়ে ইংল্যান্ডে থাকা আকর্ষণীয় প্রাকৃতিক পরিবেশ, ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যের প্রসার, স্বল্পমূল্যে শ্রমিকের যোগান, অফুরন্ত মূলধন, তৎকালীন সময়ের জন্য উন্নত পরিবহন ব্যবস্থা, বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতির আবিষ্কার ইত্যাদি সামগ্রিক কারণ গুলো শিল্প বিপ্লবের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিল। 

১৭৬০-১৮০০ সালের মধ্যবর্তী সময়ে মানুষ শিল্পায়নের স্বাদ পেলেও, তারা ত্রাসের রাজত্ব থেকে মুক্তি পায়নি। কিন্তু ১৮৭০ সালে যখন বিদ্যুৎ আবিষ্কৃত হয়, তখন মানুষ পেয়েছে আলোকিত বিশ্ব। ২০ শতকে এসে এই উন্নয়ন আরো ত্বরান্বিত হয়েছে। ১৯৬৯ সালে ইন্টারনেট আবিষ্কারের ফলে কায়িক শ্রমের বিপরীতে বিপ্লব ঘটে মস্তিষ্কপ্রসূত জ্ঞানের। তখন থেকেই শিল্প খাতে উৎপাদনের মাত্রা কয়েক গুণ বেড়ে গেছে।

বিভিন্ন দেশের শিল্পবিপ্লব 

বিভিন্ন দেশের শিল্পে বৈপ্লবিক পরিবর্তনগুলো ধারাবাহিকভাবে নাম ও শুরুর সময়কাল সহ তুলে ধরা হলো:

  • ইংল্যান্ডের শিল্প বিপ্লব, ১৭৬০ থেকে ১৮৪০
  • যুক্তরাষ্ট্রের আমেরিকান বিপ্লব, ১৭৭৬ 
  • ফ্রান্সের ফরাসি বিপ্লব, ১৭৮৯
  • রাশিয়ার বলশেভিক বিপ্লব/ অক্টোবর বিপ্লব/ রুশ বিপ্লব, ১৯১৭
  • জার্মানিরং জার্মান বিপ্লব, ১৯১৮
  • হাঙ্গেরির হাঙ্গেরিয়ান বিপ্লব, ১৯১৯
  • ভিয়েতনামের আগস্ট বিপ্লব, ১৯৪৫
  • চিনের চিন বিপ্লব, ১৯৪৯
  • কিউবা এর কিউবান বিপ্লব, ১৯৫৯
  • ইরানের ইসলামিক বিপ্লব/ ইরানি বিপ্লব, ১৯৭৯
  • চেকোস্লোভাকিয়া এর ভেলভেট বিপ্লব, ১৯৮৯
  • ভেনিজুয়েলা এর বলিভারিয়ান বিপ্লব, ১৯৯৮
  • জর্জিয়ার রোজ বিপ্লব, ২০০৩
  • ইউক্রেন এর অরেঞ্জ বিপ্লব, ২০০৪
  • কিরঘিজস্তান এর টিউলিপ বিপ্লব, ২০০৫

শিল্প বিপ্লবের ধারাবাহিক ইতিহাস

১৭৫০ সাল থেকে শুরু হওয়া শিল্প বিপ্লব, বর্তমানে ধারাবাহিকভাবে কয়েকটি ধাপে বৈপ্লবিক পরিবর্তণ এনেছে এই পৃথিবীতে। তৎকালীন সময় থেকে বর্তমান সময়ে সব পর্যন্ত শিল্পায়নকে চারটি বৈপ্লবিক পর্যায়ে ভাগ করা হয়েছে। এগুলোকে যথাক্রমে- প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ শিল্প বিপ্লব বলা হয়। এই চারটি ভাগকে বিস্তারিতভাবে বিশ্লেষণ করা হলো:

প্রথম শিল্প বিপ্লব

প্রথম শিল্প বিপ্লবের সূচনা হয়েছিল- বাষ্প এবং জল শক্তি ব্যবহার করে হস্তসাধিত শিল্পোৎপাদন প্রক্রিয়াকে মেশিন চালিত পদ্বতিতে রূপান্তরের মাধ্যমে। প্রাথমিকভাবে, নতুন প্রযুক্তির প্রয়োগে দীর্ঘ সময় লেগে গিয়েছিল। প্রথম শিল্প বিপ্লবের পূর্বে পৃথিবীব্যাপী রাজা, সম্রাট ও সাম্রাজ্য ভিত্তিক দেশ পরিচালনার কর্মকাণ্ড প্রচলিত ছিল। ইংরেজরা যখন পৃথিবীর শাসন করতে শুরু করতে থাকে, তখন সমগ্র পৃথিবীর সুবিধা নিয়ে তারা এই শিল্প খাতে ব্যাপক উন্নতিসাধন করেছিল।

আরও পড়ুন: বিশ্বের সবচেয়ে পুরনো ১০টি দেশ | পৃথিবীর প্রাচীনতম দেশসমূহ

প্রথম শিল্প বিপ্লবকালীন সময়কালকে নির্দিষ্ট করে ইউরোপ এবং আমেরিকার ক্ষেত্রে ১৭৬০ থেকে ১৮২০ বা ১৮৪০ এর মধ্যে ধারণা করা হয়। তখন শিল্পায়নে বৈপ্লবিক পরিবর্তনের প্রভাব পড়েছিল লৌহ শিল্প, কৃষি, খনিজ খনন কাজে এবং বিশেষ করে বস্ত্র শিল্পের উপর। সবচেয়ে কম সময়ে সবচেয়ে দ্রুততার সাথে উন্নয়ন হয়েছিল বস্ত্র শিল্পের। এর সামাজিক প্রভাব মধ্যবিত্ত শ্রেণীকে ক্রমেই শক্তিশালী করে তুলছিল। তৎকালীন ব্রিটিশ শিল্পেও বস্ত্র শিল্পের প্রভাব ছিল।

দ্বিতীয় শিল্প বিপ্লব

দ্বিতীয় শিল্প বিপ্লবকে বলা হয় প্রযুক্তিগত বিপ্লব। মানব ইতিহাসে প্রযুক্তিগত বিপ্লবের সূচনা ঘটেছিল ১৮৭১ থেকে ১৯১৪ সালের মধ্যবর্তী সময়ে। এই বিপ্লবের মূলে ছিল রেলপথ এবং টেলিগ্রাফ নেটওয়ার্কের ব্যাপক বিস্তার। এই রেলপথ এবং টেলিগ্রাফ নেটওয়ার্ক মানুষ এবং চিন্তা-ভাবনার দ্রুততর স্থানান্তরের সুযোগ তৈরী করেছিল। তখন কারখানা গুলোতে ক্রমবর্ধমান বৈদ্যুতীকরণ আধুনিক প্রোডাকশন লাইন বিকাশিত করার সুযোগ করে দিয়েছিল।

এই সময় আধুনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহারের মাধ্যমে উৎপাদন প্রযুক্তির বৃদ্ধির পাশাপাশি বিশ্বব্যাপী অর্থনীতির দুর্দান্ত প্রবৃদ্ধি হয়েছিল। আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহারের ফলে বহু শ্রমিক নির্ভর কারখানা মেশিন নির্ভর হয়ে পড়ে, এবং বেকারত্ব বৃদ্ধি পেতে থাকে।

তৃতীয় শিল্প বিপ্লব

২০ শতাব্দীর শেষের দিকে, পৃথিবীতে দুটি বিশ্বযুদ্ধের ফলে শিল্পায়ন এবং প্রযুক্তিগত অগ্রগতি পূর্বের তুলনায় অনেকটা শিথিল হয়ে গিয়েছিল। তখন শিল্প খাতে নতুন করে বৈপ্লবিক পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। এটিকে তৃতীয় শিল্প বিপ্লব কিংবা ডিজিটাল বিপ্লব বলা হয়ে থাকে। এই শিল্প বিপ্লবের এক দশক পরেই Z1 Computer আবিষ্কৃত হয়। 

Z1 কম্পিউটারে ফ্লোটিং-পয়েন্ট নাম্বার এবং বুলিয়ান লজিক ব্যবহার করে হিসাব নিকাশ করা হতো। এই কম্পিউটারের আবিষ্কারের ফলে ডিজিটাল অগ্রগতি আরো এক ধাপ এগিয়ে গিয়েছিল। তারপর যোগাযোগ প্রযুক্তিতে উল্লেখযোগ্য প্রভাব বিস্তার করতে থাকে সুপার কম্পিউটার। ফলে শিল্প খাতের উৎপাদন প্রক্রিয়াতে কম্পিউটার এবং যোগাযোগ প্রযুক্তির ব্যবহার ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পেতে থাকে। দেশ-বিদেশের নানা কারখানা গুলোতে মানব শক্তির জায়গা দখল করতে শুরু করে যন্ত্রপাতি ও কম্পিউটার নিয়ন্ত্রিত সরঞ্জাম।

চতুর্থ শিল্প বিপ্লব

চতুর্থ শিল্প বিপ্লব শব্দটি সর্বপ্রথম প্রবর্তন করেন একদল বিজ্ঞানী যারা জার্মান সরকারের জন্য একটি উচ্চ প্রযুক্তিগত কৌশল তৈরী করছিলেন। World Economic Forum -এর নির্বাহী চেয়ারম্যান ক্লাউস শোয়াব ২০১৫ সালে, ফরেন অ্যাফেয়ার্স এ প্রকাশিত একটি নিবন্ধের মাধ্যমে চতুর্থ শিল্প বিপ্লব শব্দটিকে বৃহৎ পরিসরে উপস্থাপন করেন। ২০১৬ সালে সুইজারল্যান্ডের ডেভোস-ক্লোস্টারস এ অনুষ্ঠিত ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের বার্ষিক সভার বিষয়বস্তু ছিল, “Mastering the Fourth Industrial Revolution” বা চতুর্থ শিল্প বিপ্লবকে আয়ত্ত করা।

১০ অক্টোবর, ২০১৬ সালে World Economic Forum স্যান ফ্র্যান্সিস্কোতে তাদের চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের কেন্দ্র উদ্বোধনের ঘোষণা দেয়। এটি ২০১৬ সালে শোয়াবের প্রকাশিত একটি বইয়ের বিষয় এবং শিরোনামও ছিল। এই চতুর্থ শিল্পায়ন যুগের জন্য শোয়াব এমন সব প্রযুক্তির কথা উল্লেখ করেছেন, যেগুলো Cyber-Physical System -এ হার্ডওয়্যার, সফটওয়্যার এবং বায়োলজিকে একত্রিত করে এবং পারস্পরিক সংযোগ উন্নয়নের উপর ব্যাপকভাবে প্রভাব ফেলে। 

ধারণা করা হয়, চতুর্থ বিপ্লবকালীন এই যুগটি রোবোটিক্স, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা Artificial Intelligence, ন্যানো টেকনোলজি, ডিসেন্ট্রালাজড কনসেনসাস, পঞ্চম প্রজন্মের ওয়্যারলেস প্রযুক্তি, বায়োটেকনোলজি, ইন্টারনেট অফ থিংস, ইন্ডাস্ট্রিয়াল ইন্টারনেট অফ থিংস, কোয়ান্টাম কম্পিউটিং, থ্রিডি প্রিন্টিংয়ের এবং সম্পূর্ণ স্বশাসিত যানবাহনের ক্ষেত্রে উদীয়মান প্রযুক্তির যুগান্তকারী যুগ হয়ে উঠবে। এই চতুর্থ শিল্প বিপ্লবকে COVID-19 মহামারী পরবর্তী অর্থনীতি পুনর্গঠনের কৌশলগত টেকসই সমাধান হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে World Economic Forum -এর “Great Reset” প্রস্তাবনায়।

চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের প্রধান উপাদান গুলো

বর্তমানের বৈপ্লবিক সমাজে চলতি ট্রেন্ডগুলোকে গভীরভাবে বিশ্লেষণ করলে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান পাওয়া যায়। এ সকল উপাদান গুলো কতটা ব্যাপক তা এদের ব্যবহারিক বিস্তৃতি দেখলেই অনুমান করা সম্ভব। চতুর্থ বৈপ্লবিক শিল্পায়নের জন্য প্রধান ও উল্লেখযোগ্য ডিজিটাল প্রযুক্তিগুলোর মধ্যে কয়েকটি হলো:

  • মোবাইল ডিভাইস,
  • ইন্টারনেট অফ থিংস (IoT) প্ল্যাটফর্ম,
  • অগমেন্টেড রিয়েলিটি / ওয়্যারেবল টেকনোলজি,
  • চাহিদা সাপেক্ষে কম্পিউটার সিস্টেম রিসোর্সের প্রাপ্যতা,
  • সাইবার-ফিজিক্যাল সিস্টেম,
  • চাহিদা সাপেক্ষে কম্পিউটার সিস্টেম রিসোর্সের প্রাপ্যতা,
  • কগনিটিভ কম্পিউটিং,
  • ডেটা ভিজ্যুয়ালাইজেশন এবং ট্রিগারড লাইভ ট্রেনিং,
  • প্রমাণীকরণ এবং জালিয়াতি সনাক্তকরণ প্রযুক্তি,
  • স্মার্ট সেন্সর,
  • বৈদ্যুতিক অবস্থান সনাক্তকরণ প্রযুক্তি,
  • উন্নত মানব-মেশিন ইন্টারফেস,
  • বিস্তৃত অ্যানালিটিকস এবং উন্নত প্রক্রিয়া,
  • বহুস্তরীয় গ্রাহক ইন্টারঅ্যাকশন এবং গ্রাহক প্রোফাইলিং ইত্যাদি।

সাইবার ফিজিক্যাল সিস্টেম ব্যবহার করে বাস্তব জগতের ভার্চুয়াল অনুলিপি তৈরী করা সম্ভব। এই সিস্টেমের বৈশিষ্ট্যগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো স্বাধীনভাবে ডিসেন্ট্রালাইজড ডিসিশান নেওয়ার ক্ষমতা। এছাড়া এই বিপ্লব অনেকাংশেই বৈদ্যুতিন শনাক্তকরণের ওপর নির্ভর করতে পারে। সেক্ষেত্রে উৎপাদন পদ্বতিকে স্মার্ট করতে সেট টেকনোলজি স্থাপন করতে হবে, যেন ডিজিটাইজেশন এর প্রয়োজন না হয়। বর্তমানে চতুর্থ শিল্প বিপ্লব ব্যাপক আকারে নতুন প্রযুক্তির সংযোগ করে আরো বহু উপযোগ তৈরী করছে।

শিল্প বিপ্লবের ফলাফল

শিল্প বিপ্লব মানবসভ্যতার ইতিহাসে একটি বহুল তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। মানব ইতিহাসে ১৭৫০-১৮৫০ সালে ঘটে যাওয়া কৃষি এবং বাণিজ্যিক ব্যবস্থা থেকে আধুনিক শিল্পায়নের দিকে গতি শুরু হওয়ায় অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে বিস্ময়কর পরিবর্তন ঘটে। এটি বিশ্বের বিভিন্ন সমাজ, রাষ্ট্র ও অর্থনীতির ওপর গভীর প্রভাব বিস্তার করে। মানবসভ্যতার প্রগতির পথে শিল্প বিপ্লব ছিল আশীর্বাদ স্বরূপ। 

কিন্তু এই শিল্প বিপ্লব কিছু নেতিবাচক দিকও বয়ে নিয়ে আসে। শিল্প বিপ্লবের পর থেকেই পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে দ্রুতগতিতে। শিল্পায়নের ফলে ব্যাপক জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহারে উৎপাদিত কার্বন ডাই-অক্সাইড পৃথিবীর তাপমাত্রা বাড়াতে প্রধান ভূমিকা রাখে। এই শিল্প বিপ্লবের ফলে গ্রামীণ অঞ্চলের মানুষ কাজের আশায় শহরে এসে ভিড় জমায়। ফলে গ্রামগুলো হয়ে পড়ে জনশূন্য। এই বিপ্লবের ফলে নতুন নতুন যন্ত্রের আবিষ্কার হয়। এসব যন্ত্রের সাহায্যে কলকারখানায় অল্প সময়ে ব্যাপক উৎপাদন হলেও দেশীয় কুটির শিল্পগুলো ধ্বংসের মুখে পড়ে। তবে শিল্প বিপ্লবের ফলে পৃথিবীর উন্নয়ন এতটাই দ্রুত হচ্ছে যে, এর নেতিবাচক দিকগুলো অনেকেরই দৃষ্টিগোচর হয় না।

শেষকথা

পৃথিবীর প্রতিটি ক্ষেত্রেই শিল্প অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সেই শিল্পের উৎপাদনকে আকাশচুম্বী করার জন্য শিল্প বিপ্লবের গুরুত্ব অপরিসীম। মানব সভ্যতার উন্নয়নে ১৮ শতকের শিল্প বিপ্লবের সূচনা থেকে বর্তমান সময়ে অবধি এর প্রভাব স্পষ্টভাবে লক্ষণীয়।

Scroll to Top