প্রাকৃতিকভাবে চুল লম্বা করার উপায় 

চুল আমাদের সৌন্দর্য্যের সবচেয়ে বড় দৈহিক উপাদান গুলোর একটি। সুন্দর, হাস্যজ্জল, ঝলমলে ও সুদীর্ঘ চুল একজন মানুষের সৌন্দর্য্যকে কয়েকগুণ বৃদ্ধি করে। সুন্দর ও আকর্ষণীয় চুল প্রত্যেকেরই কাম্য। বিশেষ করে মেয়েদের চুলের সৌন্দর্য্য প্রকাশ পায় তার দীর্ঘতায়। কিন্তু চুলের প্রতি অযত্ন এবং নানারকম প্রাকৃতিক ও অপ্রাকৃতিক কর্মকাণ্ডের ফলে অধিকাংশ মেয়েদেরই চুল ভঙ্গুর হয়। এতে চুলের সৌন্দর্য লোপ পায়। চুলের বৃদ্ধির জন্য বাজারে যে সকল প্রসাধনী সামগ্রী পাওয়া যায়, তা অত্যন্ত ব্যয়বহুল। তাই প্রাকৃতিকভাবে কম খরচে চুল লম্বা করার উপায়গুলো জেনে নিন এখানে।

প্রাকৃতিকভাবে চুল লম্বা করার উপায়

চুলের বৃদ্ধির জন্য বিভিন্ন প্রাকৃতিক উপাদান ব্যবহার করা যায়। তবে যেসকল উপাদানগুলো সবচেয়ে বেশি কার্যকর এবং সহজে ও সাশ্রয়ী মূল্যে পাওয়া যায় সেসকল উপাদানের ব্যবহার ও প্রয়োগ পদ্ধতি নিচে তুলে ধরা হলো:

(১) চা পাতা দিয়ে চুল লম্বা করার উপায়

চুল দ্রুত লম্বা করতে চা পাতা ব্যবহার করা অত্যন্ত কার্যকরী একটি উপায়। প্রথমে কিছু চা পাতা নিয়ে তা মিহি করে নিতে হবে। তারপর পানি দিয়ে এর মিশ্রণ তৈরি করতে হবে। এই মিশ্রণটি আপনার চুলের গোড়া ছাড়া মাথার সমস্ত চুলে ভালোভাবে মাখুন। ৩০/৪০ মিনিট পর তা ধুয়ে ফেলুন। এভাবে নিয়মিত ব্যবহার করলে অল্প দিনের মধ্যেই চুলের গ্রোথ দেখতে পাবেন।

(২) ক্যাস্টর অয়েল দিয়ে চুল লম্বা করার উপায়

ক্যাস্টর অয়েলে থাকে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন ই, ‘রাইসিনোলিক’ অ্যাসিড এবং ওমেগা-সিক্স ফ্যাটি অ্যাসিড, অ্যান্টি-ফাঙ্গাল এবং অ্যান্টি-ব্যাকটেরিয়াল উপাদান, যা চুল এবং স্ক্যাল্প ময়শ্চারাইজড করতে ও পরিষ্কার রাখতে সাহায্য করে। মাথার তালু বা স্ক্যাল্পে হওয়া বিভিন্ন ইনফেকশন, ইচিং বা চুলকানি, খুশকি ইত্যাদি দূর করতেও এটি সহায়ক। এছাড়া এতে রয়েছে ricinoleic, যা মাথার তালুতে ভালভাবে রক্তসঞ্চালন হয় যা চুলের বৃদ্ধিতে সহায়তা করে।

  • যেকোনও সাধারণ হেয়ার অয়েলের সাথে ক্যাস্টর অয়েল মিশিয়ে ম্যাসাজ করতে পারেন।
  • হাল্কা গরম করে নিয়ে সরাসরি ক্যাস্টর অয়েলও ম্যাসাজ করতে পারেন চুলের লম্বা অংশ এবং মাথার তালু বা স্ক্যাল্পে। 
  • ভালো ফলাফলের জন্য ১ চামচ ক্যাস্টর অয়েল ও ১ চামচ জলপাইয়ের তেল মিশিয়ে মাথার ত্বকে ১০ থেকে ১৫ মিনিট মালিশ করুন। ২০ মিনিট পরে ধুয়ে ফেলুন। 

খেয়াল রাখবেন, এই তেল খুবই চিটচিটে হওয়ায়, ক্যাস্টর অয়েল ম্যাসাজ করলে অন্তত ২বার শ্যাম্পু করা উচিত। নিয়মিত ব্যবহারে চুল মাঝখান থেকে ভেঙে যায় না, চুলের গোড়া শক্ত করে এবং চুলের গঠন সুদৃঢ় করে। সপ্তাহে ২বার ব্যবহারেই চুলের বৃদ্ধি দ্রুত হবে।

(৩) ডিম দিয়ে চুল লম্বা করার উপায়

ডিমে প্রচুর পরিমানে প্রোটিন থাকে, যা চুলের স্বাস্থ্য ভালো রাখতে সহায়তা করে। এই প্রোটিন মাথার ত্বকের পুষ্টি বাড়িয়ে নতুন চুল গজাতেও কার্যকর ভূমিকা রাখে। ডিমের কুসুমের মধ্যে থাকা বায়োটিন চুলকে স্বাস্থ্যজ্জল রাখে এবং প্রাকৃতিকভাবে চুলকে ময়েশ্চারাইজ করে। দ্রুত চুলের বৃদ্ধির জন্য বিভিন্নভাবে ডিম ব্যবহার করা যায়। যেমন:

  • ডিম ও অলিভ অয়েলের প্যাক তৈরি করে চুলে আর স্ক্যাল্পে লাগিয়ে ৪৫ মিনিট লাগিয়ে রাখুন। তারপর শ্যাম্পু দিয়ে চুল ধুয়ে ফেলুন।
  • একটি পাত্রে দুটি ডিম, দুই চামচ মধু ও দুই টেবিল চামচ দুধ নিয়ে মিশ্রন তৈরি করুন। তারপর চুলে লাগিয়ে ৩০ মিনিট রেখে ধুয়ে ফেলুন। 
  • ডিম, মধু ও লেবুর প্যাক তৈরি করে চুলে লাগিয়ে ৩০ মিনিট অপেক্ষা করুন। তারপর শ্যাম্পু দিয়ে চুল ধুয়ে নিন।
  • ডিম ও দইয়ের প্যাক বানিয়ে চুলের গোড়ায় ভালোভাবে মাখুন। তারপর ৩০ মিনিট অপেক্ষা করে ধুয়ে নিন।

এভাবে ব্যবহারে অল্প দিনের মধ্যেই ভালো ফলাফল পাওয়া যায়। তবে ডিম দিয়ে তৈরি প্যাক ব্যবহারের পর সব সময় ঠাণ্ডা পানি দিয়ে চুল ধুয়ে নিন।

(৪) ভিটামিন ই ক্যাপসুল দিয়ে চুল লম্বা করার উপায়

ভিটামিন ই ক্যাপসুলে অ্যান্টি অক্সিডেন্ট থাকে, যা মাথার স্ক্যাল্পের জন্য অনেকটা স্বাস্থ্যকর। এটি চুলের গ্রোথে দ্রুত কাজ করে এবং অতিরিক্ত চুল পড়া কমায়। মেডিকেল স্টোর থেকে স্বল্প মূল্যেই এই ক্যাপসুলটি নিতে পারবেন। 

ব্যবহারের জন্য একটি কাঁচের বাটিতে ক্যাপসুল থেকে তেল বের করে নিন। এর সাথে ২ চা চামচ নারিকেল তেল মেশান। সম্ভব হলে ক্যাস্টর অয়েল মেশাতে পারেন ২ চা চামচ। এবার একটি বড় বাটিতে পানি গরম করে সেই গরম পানিতে উপকরণ মেশানো বাটি রেখে নাড়তে থাকুন ৩ থেকে ৪ মিনিট মতো। এরপর একটি বোতলে ভরে রাখুন।

রাতে শোবার আগে এই তেলটি ভালো করে মাথায় ম্যাসাজ করুন। সকালে উঠে শ্যাম্পু করে নিন। সপ্তাহে ৩ বার এটি ব্যবহার করুন। নিয়মিত ১-২ মাস এটি ব্যবহার করলে চুলের যাবতীয় সমস্যা দূর হবে।

(৫) অলিভ অয়েল দিয়ে চুল লম্বা করার উপায়

চুল পড়ার সমস্যা প্রতিরোধে এবং চুল লম্বা করতে অলিভ অয়েল এর বেশ উপকারিতা রয়েছে। আমরা চুলের সমস্যায় বিভিন্ন ধরনের কেমিক্যালজাত পণ্য ব্যবহার করে থাকি। তবে সেগুলো থেকে অলিভ অয়েল অনেক বেশি উপকারিতা বহন করে এবং এটি প্রাকৃতিক উপাদান। অলেয়িক অ্যাসিড চুল পড়ার মাত্রাকে কমায়। অন্যদিকে, এই তেলের অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট সমূহ চুলের গোড়াকে রেডিক্যাল ড্যামেজ থেকে রক্ষা করে।

উপকারিতা পেতে নানাভাবে অলিভ অয়েল ব্যবহার করা যায়। যেমন: 

  • অলিভ অয়েল, দারুচিনি গুঁড়া ও মধুর হেয়ার প্যাক তৈরি করে।
  • অলিভ অয়েল ও ডিমের সাদা অংশের হেয়ার প্যাক তৈরি করে।
  • আদা ও অলিভ অয়েলের হেয়ার প্যাক তৈরি করে।

যেকোন একটি নিয়মিত ব্যবহার করলেই ১/২ মাসের মধ্যে ভালো ফলাফল পাবেন।

(৬) পেয়ারা পাতা দিয়ে চুল লম্বা করার উপায়

পেয়ারা পাতায় এর ফলের মতো ভিটামিন বি এবং সি রয়েছে, যা চুলের বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজনীয় কোলাজেন বাড়াতে সহায়তা করে। অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, অ্যান্টি-ইনফ্লেমেটরি এবং অ্যান্টি-মাইক্রোবিয়াল বৈশিষ্ট্য রয়েছে, যা মাথার ত্বক স্বাস্থ্যকর রাখে। এর লাইকোপিন উপাদান সূর্যের UV রশ্মি থেকে সুরক্ষা দেয়। 

ব্যবহারের জন্য বেশ কয়েকটি পেয়ারা পাতা পানিতে ফুটিয়ে নিন। এবার ২০ মিনিট ফুটিয়ে পানিটা আলাদা করে নিন। সেই পানি ঠান্ডা হলেই পেয়ারা পাতার সিরাম তৈরি হয়ে যাবে। এবার ঘুমানোর পূর্বে চুলের গোড়ায় এটি ব্যবহার করতে পারবেন। এটি মাথায় মাখার পর ১০ মিনিট ম্যাসাজ করুন। সকালে হাল্কা গরম পানি দিয়ে শ্যাম্পু করে ধুয়ে নিন।

(৭) মেথি দিয়ে চুল লম্বা করার উপায়

চুলের বৃদ্ধি এবং নতুন চুল গজাতে মেথির ব্যবহার করেন অনেকেই। মেথিতে প্রচুর পরিমাণে লেসিথিন থাকে, যা চুলের গোড়ায় পুষ্টি যোগায়। চুলের বৃদ্ধির জন্য মেথি, সরিষা দানা পাউডার ও অলিভ অয়েল পেস্ট তৈরি করুন। 

প্রথমে, ১ টেবিল চামচ মেথি এবং ১ চা চামচ সরিষা দানা পাউডার করে নিন। তারপর ২-৩ টেবিল চামচ কুসুম গরম পানিতে এই পাউডার ১ ঘণ্টা ভিজিয়ে রাখুন। পরে ১ চা চামচ অলিভ অয়েল মিশিয়ে পেস্ট তৈরী করুন। এই পেস্ট ভালোভাবে মাথায় ত্বকে লাগিয়ে ম্যাসাজ করুন। ১০-১৫ মিনিট রেখে শ্যাম্পু করে ধুয়ে ফেলুন। এটি ব্যবহারের ফলে-

  • চুল পড়ার সমস্যা দূর হয়।
  • চুলের খুশকি দূর হয়।
  • চুলের অকালপক্কতা রোধ হয়।
  • চুলের বৃদ্ধি এবং নতুন চুল গজাতে সহায়তা করে।
  • ময়েশ্চারাইজার ও কন্ডিশনার হিসেবে কাজ করে।

এই প্যাকটি মাসে একবার ব্যবহার করা ভালো। 

এছাড়াও নারকেল তেল, লেবুর রস ও পেঁয়াজের রস একসঙ্গে মিশিয়ে চুলে ব্যবহার করতে পারেন। অথবা, সারারাত ভেজানো চালের পানি একটি স্প্রে বোতলে ঢেলে পুরো চুলে ব্যবহার করতে পারেন। এতেও চুলের নানাবিধ উপকার হবে।

চুল লম্বা করার উপায় তেল

চুলের বৃদ্ধির জন্য বাজারে বাহিরের রকমের তেল পাওয়া গেলেও, নারকেল তেল সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য। এটি দ্রুত চুলের বৃদ্ধিতে সহায়তা করে এবং চুল ভাঙ্গা রোধ করে। নারকেল তেল বাষ্পীভূত হয় না বরং এটি আর্দ্রতা ধরে রাখে। ফ্যাটি অ্যাসিডে ভরপুর এই তেলটি মাথার ত্বকের গভীরতম স্তরগুলিকে ময়শ্চার দেয় যার ফলে চুল সিল্কি এবং উজ্জ্বল হয়। সপ্তাহে ২/১ দিন চুলে নারকেল তেল লাগান। 

আরও পড়ুন: আল্লাহর বাণী, হাদিস এবং বিখ্যাত মনীষীদের ইসলামিক উক্তি

এছাড়াও আর্গান অয়েল, ক্যাস্টর অয়েল, অলিভ অয়েল, পেঁয়াজের তেল, নিম তেল এবং বাদাম তেলের ব্যবহার করতে পারেন।

৭ দিনে চুল লম্বা করার উপায়

৭ দিনের মধ্যে চুল লম্বা করা প্রায় অসম্ভব। কারন চুল আমাদের দেহের মতোই প্রাকৃতিকভাবে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত একটি উপাদান। তাই কমপক্ষে ১-২ মাস অপেক্ষা করে নির্দিষ্ট পদ্ধতিতে চুলের যত্ন নেওয়ার পর চুলের গ্রোথ লক্ষ্য করা যায়। লম্বা চুল পেতে চাইলে, সপ্তাহে ২/৩ বার শ্যাম্পু করার পাশাপাশি নিয়ম অনুযায়ী চুলে তেল ব্যবহার করতে হবে এবং অন্যান্যভাবে চুলের যত্ন নিতে হবে।

১ মাসে চুল লম্বা করার উপায়

নির্দিষ্ট ও সঠিক জীবন পদ্ধতি অনুসরণের মাধ্যমে ১ মাসের মধ্যেই চুলের গ্রোথে উন্নয়ন দেখা সম্ভব। তার জন্য উপরোক্ত পদ্ধতিগুলোর যেকোনো একটি নিয়ম মতো ব্যবহার করুন। এছাড়াও আমলকীর পেস্ট, পুদিনা পাতা বাটা, জবা ফুল বাটা, মেহেদি বাটা ইত্যাদি ঘরোয়া উপাদান ব্যবহার করতে পারেন।

শেষকথা 

উপরোক্ত প্রাকৃতিকভাবে চুল লম্বা করার উপায়গুলো প্রয়োগ করার পাশাপাশি সঠিক খ্যাদ্যাভ্যাসও জরুরি। দুধ, ডিম, পনির, বাদাম, মাছ, পালং শাক ও ব্রকোলি ইত্যাদি প্রোটিন, ফ্যাটি অ্যাডিস, ওমেগা ৩ ফ্যাটি অ্যাসিড ও আয়রনসমৃদ্ধ খাবার নিয়মিত খান। ভেজা চুল টাওয়াল দিয়ে পেঁচানো থেকে বিরত থাকুন এবং নিয়মিত চুল আঁচড়ান। পাশাপাশি কেমিক্যালযুক্ত শ্যাম্পু বা অন্যান্য প্রসাধনী ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকুন। তাহলে অল্প দিনের মধ্যেই আপনার চুলের গ্রোথ লক্ষনীয় হবে।

Scroll to Top