অপটিক্যাল ফাইবার কাকে বলে? অপটিক্যাল ফাইবার কিভাবে কাজ করে?

অপটিক্যাল ফাইবার ক্যাবল (Optical Fibre Cable) বিজ্ঞানীদের যুগান্তরকারী এবং অত্যাধুনিক আবিষ্কার গুলোর মধ্যে একটি। প্রযুক্তি নির্ভর পৃথিবীতে আমরা প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে জানা-অজানায় অপটিক্যাল ফাইবার ব্যবহার করে থাকি। নিত্যব্যবহার্য এই অপটিক্যাল ফাইবার কাকে বলে এবং এর সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য জানা আমাদের বিজ্ঞানভিত্তিক চিন্তাধারাকে অনেকটা বিকশিত করতে পারে।

বর্তমানে ডাটা কমিউনিকেশনের জন্য তারবিহীন ও তারযুক্ত -এ দুটি মাধ্যম ব্যবহার করা হয়। তারযুক্ত মাধ্যমে কো-এক্সিয়াল ক্যাবল, টুইস্টেড পেয়ার ক্যাবল এবং অপটিক্যাল ফাইবার ক্যাবলে ডাটা ট্রান্সমিশন করা হয়। তন্মধ্যে, আলোর সিগন্যালে ডাটা ট্রান্সমিট করে বলে অপটিক্যাল ফাইবার অধিক উপযোগী। 

এই ক্যাবলটির নামের সাথে আমরা সকলেই কম-বেশি পরিচিত হলেও, অধিকাংশরাই জানিনা অপটিক্যাল ফাইবার কাকে বলে, এটি কিভাবে কাজ করে, এর গঠন, বৈশিষ্ট্য, প্রকারভেদ, সুবিধা অসুবিধা এবং ব্যবহারিক প্রয়োগ সম্পর্কে। তাই এ সকল বিস্তারিত তথ্য জেনে নিতে পারেন এই লেখা থেকে।

অপটিক্যাল ফাইবার কাকে বলে | অপটিক্যাল ফাইবার কি?

অপটিক্যাল ফাইবার হলো স্বচ্ছ কাঁচ বা প্লাস্টিক দিয়ে তৈরি একটি স্বচ্ছ ও নমনীয় ফাইবার। এটি সাধারণত সিলিকন ডাই অক্সাইড এবং প্লাস্টিক দিয়ে তৈরি হয়। এটি ইলেকটিক্যাল সিগন্যালের পরিবর্তে আলোর পূর্ণঅভ্যন্তরীণ প্রতিফলন প্রযুক্তি ব্যবহার করে। ফলে খুব দ্রুত গতিতে ডেটা স্থানান্তর করা হয়, এই পদ্ধতিকে অভ্যন্তরীণ প্রতিফলন বলা হয়।

অপটিক্যাল ফাইবার কাকে বলে
অপটিক্যাল ফাইবার কাকে বলে

গবেষণা অনুযায়ী ফাইবার অপটিক ক্যাবলের ডাটা স্থানান্তর গতি আলোর গতির সমান (প্রায় ৩ লক্ষ কিলোমিটার/ সেকেন্ড)। অপটিক্যাল ফাইবার আলোর মাধ্যমে এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে মুহূর্তের মধ্যেই ডাটা প্রেরণ করতে পারে। 

এর মাধ্যমে দীর্ঘ দূরত্বের ট্রান্সমিশন করা যায়। বৈদ্যুতিক তারের তুলনায় এর ব্যান্ডউইথও বেশি হয়, তাই দ্রুতগতিতে ডাটা প্রেরণ করা যায়। অপটিক্যাল ফাইবারের একটি তার একসাথে ২৫০০ -এরবেশি ডাটা এবং একটি অপটিক্যাল ফাইবারের ক্যাবল একসাথে কয়েক মিলিয়ন ডাটা পরিবহন করতেন সক্ষম।

অপটিক্যাল ফাইবার কিভাবে কাজ করে?

ফাইবার অপটিক ক্যাবল মূলত ক্যাবলের মোট অভ্যন্তরীণ প্রতিফলনের নীতিতে কাজ করে থাকে। আলো যখন একটি Fibre Optic Cable- এ প্রবেশ করে তখন এটি জিগ-জ্যাগ আকার বা রূপ ধারণ করে ক্যাবলের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ছুড়তে থাকে। এ ধরনের কর্মকাণ্ড শুধুমাত্র কোর এবং ক্ল্যাডিংয়ের মোট অভ্যন্তরীণ প্রতিফলনের প্রভাবে সম্ভব হয়।

Optical Fibre ক্যাবলটি আলোর সাহায্যে বিভিন্ন তথ্য আদান প্রদান করতে কাজ করে। সর্বপ্রথম তথ্যগুলোকে একটি এনালগ অথবা ডিজিটাল ডাটা ভোল্টেজে ট্রান্সফার করা হয়। সেখানের লাইট সোর্স থেকে আলো অপটিক্যাল ফাইবারের মধ্য দিয়ে পূর্ণ অভ্যন্তরীণ প্রতিফলনের মাধ্যমে পাঠানো হয়। মূলত এটি একটি লেজার বা LED ব্যবহার করে করা হয়।

ক্যাবলের ফাইবার গুলো একটি কোর এবং একটি ক্লাডিং দিয়ে তৈরি। এই কোর বা পাতলা, স্বচ্ছ তন্তু আলোর সংকেত পরিবহন করে। একইসাথে, ক্লাডিং কোরকে ঘিরে থাকা একটি স্বচ্ছ ও পুরু স্তর হয়ে আলোর সংকেতকে কোর থেকে ফিরে আসতে সাহায্য করে। 

এভাবে আলোর সংকেতটি কোর থেকে ক্লাডিং-এ প্রতিফলিত হয় এবং ফাইবার জুড়ে বিচ্ছুরিত হতে থাকে। তখন ক্যাবলের মধ্যে থাকা আলোর সংকেতটিকে একটি বিদ্যুৎ সংকেতে রূপান্তর করা হয়। তারপর বিদ্যুৎ সংকেতটি একটি কম্পিউটার বা অন্য কোনও ডিভাইসে প্রেরণ করা হয়। আলো সংকেতের গ্রাহক অপরপ্রান্ত থেকে সংকেতটি সংগ্রহ করে তা সংরক্ষণ করে। 

তবে আলো অনেকদূর পাঠালে, তা দুর্বল হয়ে পড়ে। আলোর গতি শক্তি ধরে রাখতে সিগন্যাল জেনারেটর ব্যবহার করা হয়। এই পদ্ধতি অবলম্বন করার মাধ্যমে বিদ্যুৎ এর চেয়ে খুব দ্রুত বিভিন্ন তথ্যকে ক্ষুদ্র ফাইবার তারের মাধ্যমে আদান-প্রদান করা যায়।

ফাইবার অপটিক ক্যাবলের গঠন | অপটিক্যাল ফাইবার ক্যাবলের বিভিন্ন অংশ

আলোর প্রতিফলনের মাধ্যমে ডাটা স্থানান্তরের জন্য ফাইবার অপটিক ক্যাবলগুলো পাতলা এবং নমনীয় করে তৈরি করতে হয়। তাই অন্যান্য কেবল এর মতো ধাতু দিয়ে তৈরি না করে কাঁচ বা স্বচ্ছ প্লাস্টিক দিয়ে ফাইবার অপটিক ক্যাবল তৈরি করা হয়। জটিল প্রকৃতির এই ক্যাবল তিনটি প্রধান অংশ নিয়ে গঠিত। যথা:

  • কোর (Core)
  • ক্ল্যাডিং (Cladding)
  • জ্যাকেট (Jacket)

এছাড়াও কোর এবং ক্ল্যাডিংয়ের সর্বোচ্চ নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে জ্যাকেটের নিচে ‘বাফার (Buffer)’ ব্যবহার করা হয়। এবার এই অংশগুলোর পরিচিতি সম্পর্কে জেনে নেওয়া যাক:

কোর (Core)

কোর হলো ফাইবার অপটিক কেবলার সবচেয়ে ভেতরের স্তর, যার মধ্য দিয়ে আলোক সিগন্যাল চলাচল করে। সাধারণত কোর সিলিকা মাল্টি-কম্পোনেন্ট কাঁচ বা স্বচ্ছ প্লাস্টিক দিয়ে তৈরি। এটি খুবই নমনীয় এবং পাতলা নলাকার আকারের হয়। Core -এর ব্যাস ৮-১০০  মাইক্রোমিটার পর্যন্ত হয়ে থাকে

কোর এর মূল কাজ হলো, আলোকে ক্যাবলের অভ্যন্তরে রাখা এবং এবং তার অক্ষের সমান্তরালে পরিচালনা করা। 

ক্ল্যাডিং (Cladding)

ক্ল্যাডিং হচ্ছে অপটিক্যাল ফাইবার ক্যাবলের ভেতরে থাকা দ্বিতীয় স্তর, যা কোরকে ঘিরে রাখে। এটিও স্বচ্ছ কাঁচের তৈরি, তবে কোরের তুলনায় এতে ব্যবহৃত উপাদানগুলো কিছুটা ভিন্ন। তাই ক্ল্যাডিংয়ের প্রতিসরণ সূচক কোরের তুলনায় কম। ক্ল্যাডিং এর ব্যাস ১২৫ মাইক্রোমিটার। কোর থেকে নির্গত আলোকরশ্মি প্রতিফলিত করে পুনরায় কোরে ফেরত পাঠানোই ক্ল্যাডিং এর কাজ। এর ভিত্তিতেই অপটিক্যাল ফাইবারের মাধ্যমে ডেটা স্থানান্তর সম্ভব হয়। 

বাফার (Buffer)

অপটিক ফাইবার ক্যাবলের তন্তুকে বাইরের পরিবেশের ক্ষতিকর প্রভাব থেকে রক্ষা করতে দুই ধরনের বাফার ব্যবহার করা হয়। এর জন্য সূক্ষ্ম তন্তুর উপর বাফারের আবরণ দেওয়া হয়। প্রাইমারি বাফার গুলো ১২৫ মাইক্রোমিটার ব্যাস পর্যন্ত ক্ল্যাডিংকে আবরণ করা এবং সেকেন্ডারি বাফার গুলো ৯০০ মাইক্রোমিটার পর্যন্ত আবরণ করা থাকে।

জ্যাকেট (Jacket)

কোর এবং ক্ল্যাডিং রক্ষা করতে ক্ল্যাডিংয়ের উপর প্লাস্টিক দিয়ে ঘেরা আবরণটিকে জ্যাকেট বলে। এটি ফাইবার অপটিক ক্যাবলকে জলীয়বাষ্প, মরিচা, ঘর্ষণ ইত্যাদি থেকে রক্ষা করে। তাই নমনীয় এবং ঘর্ষণ-প্রতিরোধী প্লাস্টিক দিয়ে জ্যাকেট তৈরি করা হয়। 

অপটিক্যাল ফাইবার ক্যাবলের বৈশিষ্ট্য

ডাটা স্থানান্তরের জন্য আমরা যে সকল কেবল ব্যবহার করে থাকি, তার মধ্যে অপটিক্যাল ফাইবার ক্যাবলের বৈশিষ্ট্য অন্যান্য কেবল থেকে ভিন্ন। বহুল সুবিধাজনক এই ক্যাবলের অনন্য বৈশিষ্ট্যগুলো হলো:

  • এই ক্যাবলের ডাটা স্থানান্তর গতি আলোর বেগের সমান।
  • ক্যাবলের তন্তুগুলো আকারে ছোট ও ওজন কম।
  • এটি গিগাবাইট রেঞ্জ বা তার থেকে বেশি দ্রুত গতির ব্যান্ডউইথ দিতে পারে।
  • অপটিক্যাল ফাইবার রাসায়নিকভাবে নিষ্ক্রিয় হয়।
  • উচ্চগতি সম্পন্ন ব্যান্ডউইথ থাকায় ডাটা ট্রান্সমিশন রেট অনেক বেশি।
  • একসাথে একাধিক তথ্য গন্তব্যে প্রেরণ করা যায়। 
  • ডাটার ক্ষতি হয় না এবং ডাটা হ্রাস পায় না।
  • এটা সংরক্ষণের জন্য এটি অধিক নিরাপদ এবং ডাটার গোপনীয়তা রক্ষা করতে সক্ষম।
  • শক্তির অপচয় অত্যন্ত কম হয়।
  • ফাইবার অপটিক ক্যাবল নেটওয়ার্কের ব্যাকবােন হিসেবে বেশি ব্যবহৃত হয়।
  • EMI ও এ্যাটিনেশনের প্রভাব থেকে মুক্ত।
  • ফাইবার অপটিক ক্যাবল পরিবেশের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে না।

অপটিক্যাল ফাইবার কত প্রকার (Types of Optical Fiber)

বর্তমানে অপটিক্যাল ফাইবার অনেক বেশি ব্যবহৃত একটি ক্যাবল। সাধারণত অপটিক্যাল ফাইবারের নির্দিষ্ট কোন প্রকারভেদ নেই। কারন এর ধরন নির্ভর করে:

  • প্রতিসরণ সূচক;
  • ফাইবার তৈরিতে ব্যবহৃত উপাদান;
  • আলোর বিচ্ছুরণ পদ্ধতির উপর।

এ সকল বিষয়বস্তুর বিভিন্নভাবে অপটিক্যাল ফাইবারকে বিভক্ত করা যায়। নিচে সেই প্রকারভেদগুলো তুলে ধরা হলো:

প্রতিসরণ সূচকের ভিত্তিতে প্রকারভেদ 

প্রতিসরণ সূচকের উপর ভিত্তি করে ফাইবার অপটিক ক্যাবল দুই ভাগে বিভক্ত। যথা:

  • Mono Mode Optical Fibre: এগুলোর কোর অংশ সরু, ব্যাস কম এবং ক্ল্যাডিং তুলনামূলকভাবে বড়।
  • Multi-mode Optical Fibre: এগুলোর কোর অংশ মোটা এবং ব্যাস বড়। মাল্টি মোড অপটিক্যাল ফাইবারকে আবার দুইভাগে বিভক্ত। যথা:
    • Step Index Multimode Fibre: কোরের প্রতিসরাঙ্ক সর্বত্র সমান হয়।
    • Graded Index Multimode Fiber: কোরের প্রতিসরাঙ্ক কেন্দ্র থেকে বাইরের দিকে কমতে থাকে।

ফাইবার তৈরির উপাদানের ভিত্তিতে প্রকারভেদ

ফাইবার তৈরিতে ব্যবহৃত উপাদানের উপর ভিত্তি করে ফাইবার অপটিক ক্যাবল দুই ভাগে বিভক্ত। যথা:

  • Plastic Optical Fibres: পলিমেথিল মেথাক্রাইলেট (Polymethylmethacrylate) নামক উপাদান দিয়ে তৈরি করা হয়।
  • Glass Fibres: অত্যন্ত সূক্ষ্ম এবং সরু কাঁচের ফাইবার দিয়ে তৈরি করা হয়।

কার্যপদ্ধতির উপর ভিত্তি করে প্রকারভেদ

International Telecommunication Union (ITU) -অপটিক্যাল ফাইবারের আলোর বিচ্ছুরণ পদ্ধতি বা কাজের উপর ভিত্তি করে একে দুটি প্রকারে বিভক্ত করেছে। যথা:

  • Single-Mode Fibres: সিংগেল মোড ফাইবার দীর্ঘ দূরত্বে সংকেত প্রেরণের জন্য ব্যবহার করা হয়। এই ফাইবারের একটি কেন্দ্র পথের ব্যাস ৯ মাইক্রন। লেজারের আলোক রশ্মি গুলো এর মাধ্যমে পাঠানো হয়।
  • Multimode Fibres: মাল্টিমোড ফাইবার স্বল্প-দূরত্বে সংকেত প্রেরণের জন্য ব্যবহৃত হয়। এটি ইনফ্রারেড আলোক রশ্মি ব্যবহার করে। এই ফাইবারের কেন্দ্র পথের ব্যাস ৬২ মাইক্রন হয়।

অপটিক্যাল ফাইবার ব্যবহার ও প্রয়োগ 

বর্তমানে ফাইবার অপটিক ক্যাবলের ব্যবহার বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং নানান ক্ষেত্রে এর প্রয়োগ করা হচ্ছে। যে সকল কাজে ফাইবার অপটিক ক্যাবল সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয়, সেগুলো হলো:

  • অপটিক্যাল ফাইবার সাধারণত সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয় টেলিযোগাযোগের ক্ষেত্রে
  • সমুদ্রের তলদেশ দিয়ে এক দেশের সাথে অন্য দেশের এবং এক মহাদেশের সাথে অন্য মহাদেশের নেটওয়ার্ক স্থাপনে ফাইবার অপটিক ক্যাবল ব্যবহৃত হয়। 
  • নেটওয়ার্কের ব্যাকবোন হিসেবে এই ক্যাবল ব্যবহৃত হয়।
  • আলোকসজ্জা, ছবি সম্পাদনা এবং সেন্সরের কাজে এই ক্যাবল ব্যবহৃত হয়।
  • এই ক্যাবল গুলো অপটিক্যাল রাসায়নিক সেন্সর এবং অপটিক্যাল বায়ো-সেন্সরের উপাদান হিসাবে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়।
  • ইন্টারনেট কানেকশনে ও দ্রুুত ডাটা ট্রন্সমিশনের কাজে এটি ব্যবহৃত হয়।
  • কম্পিউটার সরঞ্জামের মধ্যে অপটিক্যাল ফাইবার অ্যাপ্লিকেশন ব্যবহৃত হয়।
  • ডিশ বা স্যাটেলাইট টিভি কানেকশনের ক্ষেত্রে।
  • দূরবর্তী কোনো সংযোগে noise ছাড়া ডিজিটাল সিগন্যাল প্রেরন করতে অপটিক ফাইবার ক্যাবল ব্যবহার করা হয়।

বর্তমানে অন্যান্য ক্ষেত্রেও এই ক্যাবলের বহুল সুবিধা ও উপকারী বৈশিষ্ট্য থাকায় এর ব্যবহার বৃদ্ধি পাচ্ছে।

চিকিৎসা ক্ষেত্রে অপটিক্যাল ফাইবারের ব্যবহার

অপটিক্যাল ফাইবারের সবচেয়ে বড় প্রায়োগিক ক্ষেত্রগুলোর মধ্যে একটি হচ্ছে চিকিৎসা। বর্তমানে রোগ নির্ণয়, চিকিৎসা, ঔষধ তৈরি, অস্ত্রোপচার ও চিকিৎসাভিত্তিক গবেষণার বহু কাজে ফাইবার অপটিক ক্যাবল ব্যবহার করা হয়। এর কিছু ব্যবহার ও প্রয়োগ তুলে ধরা হলো:

রোগ নির্ণয়: Optical Fibre Camera মানবদেহে রোগ নির্ণয়ের জন্য ব্যবহৃত হয়। দেহের অভ্যন্তরে আক্রান্ত স্থানে এই ক্যামেরাগুলো প্রেরণ করে অন্ত্রের ক্যান্সার সনাক্ত করা সম্ভব হয়।

চিকিৎসা: বিভিন্ন প্রকার অপটিক্যাল ফাইবার চিকিৎসার কাজে ব্যবহৃত হয়। যেমন: ফাইবার ক্যাথেটার গুলো ওষুধে ব্যবহার এবং ফাইবার তরল গুলো শরীরের বিভিন্ন অংশে প্রবেশ করানোর মাধ্যমে উন্নত চিকিৎসা সেবা দেওয়া যায়। ইতিমধ্যেই শরীরের অঙ্গে বহিরাগত সংকেত প্রেরণ করা সম্ভব হয়েছে।

অস্ত্রোপচার: মানবদেহের বিভিন্ন স্থানে অস্ত্রোপচার করার সময় দেহের অভ্যন্তরীণ অঙ্গ গুলোর একটি স্পষ্ট দৃশ্য পেতে Optical Fibre Camera ব্যবহার করা হয়। এর ফলে নিখুঁতভাবে অস্ত্রোপচার করা যায় এবং মানবদেহের ক্ষতি কম হয়।

গবেষণা: Optical Fibre Camera চিকিৎসা গবেষণায় ব্যবহৃত হয়। বিভিন্ন রোগের অ্যান্টিবায়োটিক তৈরিতে, রোগ নিরাময়ের গবেষণায়, বড় রোগের লক্ষণ প্রভাব এবং প্রতিকারের উপায় নিয়ে গবেষণা, দেহে অভ্যন্তরীণ কোষ নিয়ে জটিল রোগের ঔষধ আবিষ্কারের গবেষণায় এই ফাইবার ব্যবহৃত হয়।

সর্বোপরি, চিকিৎসায় উন্নয়নের ক্ষেত্রে অপটিক ফাইবারের অবদান অনেক।

ফাইবার অপটিক সেন্সর (Fibre Optic Sensor)

অপটিক্যাল ফাইবার সেন্সরকেতাপমাত্রা, চাপ, টানসহ বিভিন্ন প্রকার উপাত্ত সংগ্রহের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করা হয়। এই ফাইবার আকারে ছোট এবং বিদ্যুৎ সাশ্রয়ী হওয়ায় তড়িৎ সেন্সরের থেকে এটি বেশি সুবিধাজনক এবং গ্রহণযোগ্য।

বর্তমানে সেসিমিক সোনার (Seismic sonar) -এর হাইড্রোফোন হিসেবে অপটিক্যাল ফাইবার ব্যবহৃত হচ্ছে। প্রায় ১০০ টিরও বেশি সেন্সর নিয়ে তৈরি হয়েছে হাইড্রোফোন সেন্সর সিস্টেম। তেল শিল্পে এই হাইড্রোফোন সেন্সর ব্যবহার করা হয়। তেলকুপের তাপমাত্রা ও চাপের জন্য অপটিক্যাল ফাইবার সেন্সর অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তাছাড়া অর্ধ-পরিবাহী সেন্সরগুলো তেলকুপের তাপমাত্রা ও চাপ সহ্য করতে পারে না বলে ফাইবার অপটিক উপযুক্ত।

বোয়িং ৭৬৭ এর অপটিক্যাল গাইরোস্কোপ সেন্সর হিসেবেও এই ফাইবার সেন্সর ব্যবহৃত হচ্ছে। বর্তমানে একটি জার্মান প্রতিষ্ঠান এই ফাইবার দিয়ে লেজার মাইক্রোফোন তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে।

অপটিক্যাল ফাইবার ক্যাবলের সুবিধা ও অসুবিধা

ফাইবার অপটিক ক্যাবল অনেক বেশি আধুনিক বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন এবং সুবিধাজনক। অধিক সুবিধার পাশাপাশি এর কিছু অসুবিধা বা সীমাবদ্ধতাও রয়েছে। Optical Fibre Cable -এর সুবিধা ও অসুবিধা গুলো নিচে তুলে ধরা হলো:

অপটিক্যাল ফাইবারের সুবিধাসমূহ 

  • অপটিক্যাল ফাইবারের মাধ্যমে বিদ্যুৎ সংকেতের তুলনায় অনেক বেশি তথ্য পরিবহন করতে পারে।
  • বিদ্যুৎ সংকেতের তুলনায় এই ফাইবারে ডেটার ক্ষতি কম হয় এবং বেশি নিরাপদ।
  • এ ধরনের ক্যাবলগুলো বেশি দূরত্বে তথ্য পরিবহন করতে পারে।
  • ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক ফিল্ড দ্বারা প্রভাবিত হয় না।
  • অপটিক্যাল ফাইবারে ডাটা স্থানান্তরের জন্য বিদ্যুতের পরিবর্তে আলো ব্যবহার করা হয় বলে শর্ট সার্কিটের কোন ঝুঁকি নেই।
  • ফাইবার অপ্টিক ক্যাবল টেলিফোন, ইন্টারনেট, টেলিভিশন, ভিডিও এবং অডিও সিগন্যাল পরিবহন করতে পারে।
  • এটি কম্পিউটার নেটওয়ার্ককে সংযুক্ত করতে পারে।
  • চিকিৎসা ক্ষেত্রে অস্ত্রোপচার এবং রোগ নির্ণয় করতেও এটি ব্যবহার করা যায়।
  • বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠানে পরিমাপ, নিয়ন্ত্রণ এবং অটোমেশনের কাজে সহায়তা করে।
  • এটি সহজে পরিবহনযোগ্য এবং ওজনে হালকা।
  • পরিবেশের তাপ, চাপ ইত্যাদির প্রভাব হতে নিরাপদ।

অপটিক্যাল ফাইবারের অসুবিধা

  • অপটিক্যাল ফাইবার ক্যাবল অত্যন্ত দামি এবং তামার তারের চেয়ে বেশি ব্যয়বহুল।
  • Optical Fibre Cable খুব বেশি বাঁকানো যায় না। কারণ এই তারের স্বচ্ছ কাজ এবং সূক্ষ্ম প্লাস্টিক দিয়ে তৈরি। তাই বাঁকালে ভেঙে যেতে পারে, ফলে এর স্প্লিসিং খুব কঠিন হয়।
  • অধিক দূরত্বে ডাটা স্থানান্তরের ক্ষেত্রে আলোর বিচ্ছুরণ পদ্ধতির দুর্বলতা দেখা দেয়। এ ধরনের নেতিবাচক অবস্থা মোকাবেলার জন্য অতিরিক্ত অপটিক্যাল উপাদান ব্যবহার করতে হয়। 
  • সাধারণ তারের মতো ফাইবার অপটিক ক্যাবল হাতে জোড়া দেওয়া যায় না। বরং তার জন্য ফাইবার জয়েন্ট মেশিন প্রয়োজন হয়, যা অত্যন্ত ব্যয়বহুল। 
  • এই ক্যাবলগুলোর কোথাও সংযোগ বিচ্ছিন্ন হলে বা কোন সমস্যা দেখা দিলে তা মেরামত করা কঠিন হয়। এর জন্য দক্ষ কারিগর প্রয়োজন হয়।
  • সর্বোপরি, অপটিক্যাল ফাইবার স্থাপন, পরিচালনা, রক্ষণাবেক্ষণ ও মেরামতের জন্য অধিক ব্যয় করে, দক্ষ ও কারিগরি জ্ঞানসম্পন্ন জনবল নিয়োগ দিতে হয়।

অপটিক্যাল ফাইবার আবিষ্কারের ইতিহাস 

বর্তমানের মানুষের জীবনকে সহজ এবং উন্নত করে তুলতে অত্যাধুনিক প্রযুক্তির অন্যতম একটি হলো ফাইবার অপটিক ক্যাবল। এই প্রযুক্তিটির আবির্ভাব হয়েছিল ১৮ শতকের শুরুর দিকে। অপটিক ফাইবার নিয়ে বহু পরীক্ষা নিরীক্ষার পর, ১৮০০ সালে প্রতিমান হয় যে, আলো পানির স্রোতের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়। এই পরীক্ষার উদ্ভাবক ছিলেন জিন ‘ডেনিয়েল কোলাডন’। অন্য একটি পরীক্ষায় উইলিয়াম হুইলার কর্তৃক আবিষ্কৃত হয় যে, আলো একটি কাঁচের দন্ডের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়। 

১৮৪০ সালে প্যারিসে প্রতিসরণের মাধ্যমে আলোক প্রেরণের ধারণা প্রথম আবিষ্কার করেছিলেন- ‘জ্যাকিস বেবিনেট’ এবং ‘ডেনিয়েল কোলাডন’। প্রায় ১২ বছর পরে জন ‘টিন্ডাল’ লন্ডনে এই বিষয়ে তার ধারণা ব্যক্ত করেছিলেন। ১৮৭০ সালে ‘টিন্ডাল’ আলোর পূর্ণ অভ্যন্তরীণ প্রতিফলন বিষয়ে আলোকপাত করেছিলেন তাঁর আলোর ধর্ম সম্পর্কিত একটি বইয়ে। এ বিষয়ে বইতে উল্লেখিত ছিল- আলো যখন বায়ু থেকে পানিতে প্রতিসরিত হয়, তখন অভিলম্বের দিকে বেঁকে যায়, আর যখন পানি থেকে বায়ুতে প্রতিসরিত হয় তখন অভিলম্ব থেকে দূরে সরে যায়।

১৯ শতকের শেষের দিকে এবং ২০ শতকের শুরুতে মানবদেহের অভ্যন্তরে আলোকিত করার কাজে বাঁকানো কাঁচের নলকে আলোক সঞ্চালক রূপের ব্যবহার করা হতো। তখন দাঁতের চিকিৎসায় মুখের অভ্যন্তরে আলোকিত করার জন্য সরু কাঁচের নলের প্রয়োগ শুরু হয়। পরবর্তীতে ১৯২০ সালে দলের মধ্য দিয়ে প্রতিবিম্ব প্রেরণ করার পদ্ধতি স্বয়ংক্রিয়ভাবে সর্বপ্রথম ব্যবহার করেন টেলিভিশন পাইওনিয়ার- ‘জন লজি বেয়ার্ড’ ও রেডিও নিরীক্ষক- ‘ক্ল্যারেন্স হ্যানসেল’।

আরো পড়ুন: বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট এর সামগ্রিক তথ্য ও সাধারণ জ্ঞান

১৯৩০ সালে এই ফাইবার প্রযুক্তির নতুন যাত্রা শুরু হয়। তখন গবেষণার অংশ হিসেবে ‘হেনরিক লোম’ একটি কাঁচের ফাইবারের মাধ্যমে ফিলামেন্টের একটি চিত্র পাঠিয়েছিলেন। যদিও সেই ছবিটি খুব অস্পষ্ট ছিল, তবে এটাই ছিল অপটিক্যাল ফাইবারের আলোর মাধ্যমে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে ডাটার স্থানান্তরের প্রথম সফলতা।

যুগ যুগ ধরে বহু পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলতে থাকে। বর্তমানে আমরা যে সর্বাধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে ফাইবার অপটিক ক্যাবল ব্যবহার করছি তা মূলত বিজ্ঞানী মোলারের উদ্ভাবন করা।

অপটিক্যাল ফাইবার ক্যাবলের দাম কত?

ফাইবার অপটিক ক্যাবলের দাম নির্ভর করে এর কোম্পনী, কোয়ালিটি, প্রকার, দৈর্ঘ্য এবং ব্যাসের উপর। বাংলাদেশের যে সকল ফাইবার কেবল গুলো ব্যবহৃত হয়, তাদের বর্তমান দাম সম্পর্কে নিচে ধারণা দেওয়া হলো:

  • ২ কোরের অপটিক্যল ফাইবার ব্রান্ড ভেদে প্রতি মিটার ১০ টাকা থেকে ১৩ টাকা।
  • ৪ কোরের অপটিক্যল ফাইবার ব্রান্ড ভেদে প্রতি মিটার ১২ থেকে ১৬ টাকা। 
  • ৬ কোরের অপটিক্যল ফাইবার ব্রান্ড ভেদে প্রতি মিটার ১৮ থেকে ১১০ টাকা। 
  • ১২ কোরের অপটিক্যল ফাইবার ব্রান্ড ভেদে প্রতি মিটার ২৯ থেকে ৫০ টাকা। 
  • ২৪ কোরের অপটিক্যল ফাইবার ব্রান্ড ভেদে প্রতি মিটার ১২০ থেকে ২০০ টাকা। 
  • ৪৮ কোরের অপটিক্যল ফাইবার ব্রান্ড ভেদে প্রতি মিটার ১৫০ থেকে ৩০০ টাকা। 

এখানে ২ ও ৪ করে অপটিক ফাইবার কেবল গ্রাহক পর্যায়ে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয়। তবে ১২ কোর থেকে বেশি কোরের ক্যাবল গুলো কমার্শিয়াল ডাটাট্রন্সমিশনের কজে ব্যবহৃত হয়।

ফাইবার জয়েন্ট মেশিন দাম কত?

অপটিক্যাল ফাইবার সাধারণত অতি সূক্ষ্ম কাছের তন্তু বা চিকন তার। যখন দুই টি অপটিক্যাল ফাইবার তারের মধ্যে সংযোগ স্থাপন করতে হয়, তখন অতি সূক্ষ্ম এই তারগুলোকে হাতের জোড়া দেওয়া যায় না। তাই এর জন্য স্প্লাইসার মেশিনের প্রয়োজন হতে পারে‌। 

বর্তমানে বাজারে বিভিন্ন ধরনের, মডেলের এবং ভিন্ন ভিন্ন দামের স্প্লাইসার লাইসার মেশিন। নিচে ক্যাবলের ধরন ও মডেল অনুযায়ী ভিন্ন ভিন্ন মেশিনের মূল্য তালিকা দেওয়া হলো:

  • AC-Net F-90X -এর মূল্য প্রায় ১,০৪,৯০০ টাকা।
  • Splicer Machine DVP-760 -এর মূল্য প্রায় ৭৯,৯৯৯ টাকা। 
  • Fiber Fox Mini 6SI -এর মূল্য প্রায় ১,৩০,৯০০ টাকা।
  • A3 ARC Fiber Optic Fusion -এর মূল্য প্রায় ৭২,৯৯৯ টাকা।

শেষকথা

উপরোক্ত আলোচনা থেকে আমরা অপটিক্যাল ফাইবার কাকে বলে এবং অপটিক্যাল ফাইবার সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য জানতে পারলাম। ১৮৪০ সালে জ্যাকিস বেবিনেট এবং ডেনিয়েল কোলাডন প্রতিসরণের মাধ্যমে আলোক প্রেরণের ধারণাটি আবিষ্কার করার পর থেকে পৃথিবীব্যাপী বহু ক্ষেত্রে ফাইবার অপটিক ক্যাবল গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলে এসেছে এবং এর ব্যবহার নতুন নতুন ক্ষেত্রে বৃদ্ধি পাচ্ছে।  

Scroll to Top