পেলভিক ব্যথা (Pelvic Pain) নারীদের মধ্যে একটি সাধারণ কিন্তু জটিল সমস্যা। অনেক সময় এই ব্যথা সাময়িক বা হালকা হলেও, এটি দীর্ঘস্থায়ী ও তীব্র আকার নিতে পারে। পেলভিক অঞ্চল হলো নারীর তলপেটের নিচের অংশ, যেখানে জরায়ু, ডিম্বাশয়, মূত্রথলি, অন্ত্রসহ গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গসমূহ থাকে। তাই এই অঞ্চলের ব্যথা অবহেলা করলে গুরুতর রোগ বা জটিলতায় রূপ নিতে পারে।
বাংলাদেশে অনেক নারী পেলভিক ব্যথাকে গুরুত্ব দেন না, ফলে সমস্যা গুরুতর পর্যায়ে পৌঁছে যায়। তাই পেলভিক ব্যথার কারণ, লক্ষণ, রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসা সম্পর্কে সঠিক ধারণা থাকা অত্যন্ত জরুরি।
পেলভিক ব্যথার কারণ
পেলভিক ব্যথার নানা কারণ থাকতে পারে। এগুলোকে সাধারণভাবে চার ভাগে ভাগ করা যায়:
১. স্ত্রীরোগজনিত কারণ (Gynecological Causes)
- ডিম্বাশয়ের সিস্ট (Ovarian Cyst): ডিম্বাশয়ে তরল ভর্তি সিস্ট হলে তলপেটে টানটান ব্যথা হয়।
- এন্ডোমেট্রিওসিস (Endometriosis): জরায়ুর টিস্যু অস্বাভাবিকভাবে বাইরে বৃদ্ধি পেলে তীব্র ব্যথা সৃষ্টি করে।
- পেলভিক ইনফ্ল্যামেটরি ডিজিজ (PID): প্রজনন অঙ্গের সংক্রমণে দীর্ঘস্থায়ী ব্যথা হয়।
- ফাইব্রয়েড (Fibroid): জরায়ুর ভেতরে অস্বাভাবিক টিউমারের মতো গঠন পেলভিক ব্যথার অন্যতম কারণ।
- ডিম্বস্ফোটনজনিত ব্যথা (Ovulation Pain): মাসিক চক্রের মাঝামাঝি সময়ে অনেক নারীর তলপেটে ব্যথা হয়।
২. মূত্রতন্ত্র সম্পর্কিত কারণ
- ইউরিনারি ট্র্যাক্ট ইনফেকশন (UTI)।
- ব্লাডার ইনফেকশন (Cystitis)।
- কিডনি বা ইউরিনারি স্টোন।
৩. পরিপাকতন্ত্র সম্পর্কিত কারণ
- কোষ্ঠকাঠিন্য বা গ্যাসের সমস্যা।
- ইরিটেবল বাওয়েল সিনড্রোম (IBS)।
- ইনফ্ল্যামেটরি বাওয়েল ডিজিজ (IBD)।
৪. মাংসপেশি ও হাড়ের কারণ
- পেলভিক ফ্লোর মাংসপেশির টান।
- কোমরের হাড় বা জোড়ের সমস্যা।
৫. গুরুতর কারণ
- সার্ভিক্স বা জরায়ুর ক্যান্সার।
- ডিম্বাশয়ের ক্যান্সার।
- প্রজনন অঙ্গের অন্যান্য জটিলতা।
পেলভিক ব্যথার লক্ষণ
বর্তমানে পেলভিক ব্যথার প্রকৃতি ও তীব্রতা রোগভেদে ভিন্ন হতে পারে। সাধারণত নিচের লক্ষণগুলো দেখা যায়:
- তলপেট বা কোমরের নিচে স্থায়ী বা মাঝে মাঝে ব্যথা।
- মাসিকের সময় অস্বাভাবিক ব্যথা ও রক্তপাত।
- যৌনমিলনের সময় বা পরে ব্যথা।
- যোনি থেকে দুর্গন্ধযুক্ত স্রাব।
- জ্বর বা ঠান্ডা লাগা (সংক্রমণের ক্ষেত্রে)।
- ঘন ঘন প্রস্রাবের চাপ বা প্রস্রাবের সময় জ্বালা।
- পেট ফাঁপা, গ্যাস বা কোষ্ঠকাঠিন্য।
- গর্ভাবস্থায় অস্বাভাবিক ব্যথা।
পেলভিক ব্যথার রোগ নির্ণয়
সঠিক চিকিৎসার জন্য পেলভিক ব্যথার মূল কারণ নির্ণয় জরুরি। এজন্য ডাক্তাররা বিভিন্ন ধাপে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে থাকেন।
১. শারীরিক পরীক্ষা
ডাক্তার পেলভিক অঞ্চলের অবস্থা ও অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ স্পর্শ করে মূল্যায়ন করেন।
২. ল্যাব টেস্ট
- রক্ত পরীক্ষা।
- প্রস্রাব পরীক্ষা।
- সংক্রমণ শনাক্তে কালচার টেস্ট।
৩. ইমেজিং টেস্ট
- আল্ট্রাসোনোগ্রাফি: জরায়ু ও ডিম্বাশয়ের গঠন দেখা হয়।
- MRI/CT Scan: জটিল কেসে ব্যবহার করা হয়।
৪. ল্যাপারোস্কপি
এন্ডোমেট্রিওসিস বা অজানা কারণে ব্যথা নির্ণয়ে ব্যবহৃত হয়।
পেলভিক ব্যথার চিকিৎসা
পেলভিক ব্যথার চিকিৎসা নির্ভর করে ব্যথার কারণ ও তীব্রতার উপর।
১. ওষুধ
- ব্যথানাশক ট্যাবলেট।
- সংক্রমণের ক্ষেত্রে অ্যান্টিবায়োটিক।
- হরমোন থেরাপি (যেমন PCOS বা এন্ডোমেট্রিওসিসে)।
২. সার্জারি
- সিস্ট বা ফাইব্রয়েড বড় হলে অস্ত্রোপচার।
- এন্ডোমেট্রিওসিস বা PID জটিল হলে ল্যাপারোস্কপিক সার্জারি।
৩. ফিজিওথেরাপি
পেলভিক ফ্লোর মাংসপেশি দুর্বল হলে ফিজিওথেরাপি কার্যকর।
৪. জীবনধারার পরিবর্তন
- নিয়মিত ব্যায়াম ও যোগব্যায়াম।
- প্রচুর পানি পান ও স্বাস্থ্যসম্মত খাদ্যাভ্যাস।
- ধূমপান ও অ্যালকোহল এড়িয়ে চলা।
- মানসিক চাপ কমানো ও পর্যাপ্ত ঘুম।
কখন গাইনি ডাক্তারের কাছে যাবেন?
- পেলভিক ব্যথা দীর্ঘদিন স্থায়ী হলে।
- মাসিকের সময় অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ বা অস্বাভাবিকতা দেখা দিলে।
- যৌনমিলনের সময় বা পরে ব্যথা অনুভব করলে।
- গর্ভাবস্থায় তীব্র ব্যথা হলে।
- যোনি থেকে দুর্গন্ধযুক্ত স্রাব ও জ্বর থাকলে।
পেলভিক ব্যথা প্রতিরোধে করণীয়
- নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা।
- মাসিকের সময় পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা।
- নিরাপদ যৌনচর্চা।
- স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন।
- শারীরিক সমস্যাকে অবহেলা না করে দ্রুত ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া।
উপসংহার
পেলভিক ব্যথা একটি সাধারণ সমস্যা হলেও এর পেছনে গুরুতর কারণ লুকিয়ে থাকতে পারে। তাই ব্যথাকে অবহেলা না করে দ্রুত সঠিক রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসা নেওয়া প্রয়োজন। সময়মতো চিকিৎসা নিলে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সুস্থ হওয়া সম্ভব।
যদি আপনি অভিজ্ঞ গাইনি ডাক্তার খুঁজে পেতে চান, তবে এখানে দেখে নিতে পারেন গাইনি ডাক্তারের তালিকা ঢাকা। সঠিক চিকিৎসক নির্বাচন করলে পেলভিক ব্যথার সঠিক সমাধান পাওয়া অনেক সহজ হয়ে যায়।
Somoy Media All Time Information