প্রবাস জীবন

প্রবাস জীবন-দেশে প্রবাসীদের গুরুত্ব

মা বাবা ছেলেমেয়ে ও পরিবারের সবার চাহিদা মান অভিমান রাখতে গিয়ে প্রবাসীরা নিজের জীবন বিলিয়ে দেন । তারা ভুলে যান যে তাদেরও হয়তো জীবন ছিল, কিছু চাহিদা ছিল, কিছু শখ ছিল। সারাদিন শুধু চিন্তা করেন কিভাবে আরো বেশি উপার্জন করা যায়, আরো বেশি টাকা আয় করা যায়। এই কাজে ব্যস্ততার মাঝে কেটে যায় তাদের এই জীবন। হয়তো একেই বলে এক ধরনের দেয়ালবিহীন কারাগার। নিজের মনের সাথে যুদ্ধ করে এভাবেই তাদেরকে কাটাতে হয় প্রবাস জীবন।

প্রবাসী সম্পর্কে অপ্রবাসীদের ধারণা পুরোটাই অর্থকেন্দ্রিক। অর্থাৎ, প্রবাসী মানে অঢেল অর্থ উপার্জনের কারিগর। স্বজনেরা অন্তত ওই একটি বিষয়ে পরোপুরি সজাগ। প্রবাসী মানে, থাকবে অর্থিক সচ্ছলতা। এই ধারণাটা মোটেই ভুল নয়। কিংবা নতুন কিছু নয়। এটা তো ঠিক বাংলাদেশের সমৃদ্ধ অর্থনীতির চাকা ঘোরানোর চাবিকাঠি তো দীর্ঘকাল ধরেই প্রবাসীদের নিয়ন্ত্রণে। বাংলাদেশ ব্যাংক বছর ঘুরে গুনছে হাজার কোটি ডলারের বেশি বৈদেশিক মুদ্রা! তাই বুঝতে কারও কষ্ট হয় না, প্রবাসী মানে হাড়ভাঙা পরিশ্রমী একদল খেটে খাওয়া মানুষ।

আসলে প্রবাস জীবন আমাদের এ জীবনের চেয়ে অনেক ভিন্ন। এই ভিন্ন চলমান জীবন ও তাদের সম্পর্কে নানা আনুষঙ্গ নিয়ে বিস্তারিত লিখছি আজ।

প্রবাসী

এদেশ ছেড়ে কাজ করার জন্য যারা বিদেশ চলে যায় তাদেরকে আমরা প্রবাসী বলি। তারা আপন জায়গা ছেড়ে ও সব কিছুর মায়া ত্যাগ করে প্রবাসে চলে যান । কেন যান?

 আসলে এর মূল কারণ হলো আমাদের দেশের কর্মসংস্থানের অভাব আমাদের দেশে পর্যাপ্ত কর্মসংস্থান না থাকায় ও কাজের মজুরি বা বেতন কম থাকায় তাদের সম্মান নিয়ে চলতে, দুবেলা খেতে এবং আপনজনদের যেমন ছেলে মেয়ে ও বাবা-মার সব আবদার ও চাহিদা পূরণ করতে হিমশিম খেতে হয়। বিদেশে বা প্রবাসে কাজের সুযোগ ও ভালো পারিশ্রমিক থাকায় তারা শুধুমাত্র টাকার কথা চিন্তা করেই নিজের মনের বিরুদ্ধে লড়াই করে প্রবাসে চলে যান।

দেশ থেকে প্রবাসে গিয়ে কি খুব ভালো থাকে কেউ? না, দেশ থেকে সবকিছু ছেড়ে যেমন তার মা-বাবা, ভাই-বোন, স্ত্রী-সন্তান, আত্মীয়-স্বজনদের রেখে যখন প্রবাসে একা একটা মানুষ যায় বা কাজ করে তখন তার মনটা কিন্তু পড়ে থাকে দেশের মাটিতেই। মনে পড়ে তার মা-বাবার কথা, ভাই-বোনের কথা, স্ত্রী-সন্তানের কথা। তখন তার আর কাজ করতে ইচ্ছে হয় না।

ইচ্ছে হয় সবকিছু ছেড়ে দিয়ে পুনরায় দেশে চলে আসতে। কিন্তু না, সময় এবং পরিস্থিতি তা করতে দেয় না, কেননা সে যদি বিদেশ থেকে দেশে এসে পড়ে তবে তার আপন মানুষগুলো অর্থকষ্টে ভুগবে, তিনবেলার খাবার একবেলা খেতে হবে, কোনো কোনো বেলা আবার না খেয়েই থাকতে হবে। এটা তার চোখের সামনে ঘটলে সে সহ্য করতে পারবে না। 

তাই ইচ্ছে হলেও সবকিছু ছেড়ে দিয়ে পুনরায় দেশে চলে আসতে পারেন না প্রবাসীরা ।

কতটা সুখ ও বিলাসিতায় আছে প্রবাসীরা ?

দুঃখ বিলাসী ওরাই হয় যাদের জীবনে সুখের ছোঁয়া লাগে, যাদের জীবনে সুখ শান্তির নেই কোনো অন্ত নেই কোনো অভাব।প্রবাসীরা তাদের কেউ নয় , তারাএতটুকু সুখ সন্ধানী। একজন খেটে খাওয়া মানুষ তার জীবনে সুখের ছোঁয়া লাগেনি। প্রবাসী নিঃসঙ্গ জীবনে সুখ আছে বলে আমি বিশ্বাস করি না। সুখ খুঁজতে গেলে অবশিষ্ট সুখটুকু হারিয়ে ফেলতে হবে তাদের।

তারা না ঘুমিয়ে, সময়মতো না খেয়ে, ক্ষুধার্ত পেট নিয়ে দেশের জন্য, দেশের মানুষের জন্য কাজ করে যাচ্ছে। তবে তারাও সুখের কাঙাল। তারাও সুখ চায়। আর তারা তখনই সুখ পায় যখন কিনা তারা প্রবাস থেকে নিজের দেশে কিছু নিয়ে আসে বা প্রিয় মানুষদের হাতে তুলে দিতে পারে তাদের কষ্টের টাকা। তারা তখন আনন্দ পায়, সুখে আত্মহারা হয়ে ওঠে। তাদের কাছে তখন মনে হয় তাদের প্রবাস জীবন সার্থক। সার্থক হয়ে উঠবারই কথা, তারা যে কারণে দেশ ছেড়ে প্রবাসে গিয়ে কষ্টের জীবন বেছে নিয়েছে সে জীবনের যে মূল কথা ছিল তাদের বাবা-মায়ের মুখে হাসি ফুটিয়ে তোলা, স্ত্রী-সন্তানের জন্য ভালোভাবে জীবন কাটানোর জন্য কিছু সময় নিয়ে আসা এটাই যেন তাদের কাছে বড় পাওয়া বলে মনে হয়।

কেননা তারা তো এটার জন্যও বিদেশে দেশ ছেড়ে। প্রবাসে কী কেউ সুখের জন্য যায়? না প্রবাসে কেউ নিজের সুখের জন্য যায় না বরং অন্যের সুখটা দেখার জন্য প্রবাসে যায় দেশ ছেড়ে। তারা তাদের অর্জিত কাঙ্খিত সম্পদ দিয়ে যখন প্রিয় মানুষগুলোর জন্য প্রিয় কিছু নিয়ে আসে তখন তাদের ভালো লাগে বরং আনন্দ হয় যখন কিনা তারা বুঝতে পারে, দেখতে পারে তাদের প্রিয় মানুষ, কাছের মানুষের আনন্দ তখন তারা রীতিমতো অবাক হয়, বিস্মিত হয়।

কিভাবে কাটছে তাদের জীবন ?

বাংলাদেশের বিশাল একটি জনগোষ্ঠী প্রবাসে বাস করে। স্বাধীনতা পরবর্তী পাঁচ দশকে বাংলাদেশের বড় অর্জনগুলোর তালিকায় প্রবাসী আয় অন্যতম। এক কোটির বেশি বাংলাদেশি ছড়িয়ে আছে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে, যারা প্রতিনিয়ত দেশের টেকসই উন্নয়নে অবদান রেখে যাচ্ছে। মাথার ঘাম পায়ে ফেলে অর্থ উপার্জনকারী এসব প্রবাসীর অধিকাংশের পরিবার-পরিজন কিন্তু দেশে থাকে। ইউরোপ-আমেরিকা বাদ দিলে অন্যান্য দেশে বসবাসকারী বাংলাদেশি প্রবাসীদের খুব কম সংখ্যক পরিবার তাদের সাথে প্রবাসে থাকে। প্রযুক্তিগত উৎকর্ষের ফলে প্রবাসীরা এখন নিয়মিত দেশে অবস্থানরত পরিবার-পরিজনের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করে চলে। ইচ্ছে হলেই আপনজনদের দেখা বা কথা বলা কোনো ব্যাপার না। তবে তা কেবল ভার্চুয়াল। এই যোগাযোগ আপাত দূরত্ব কমালেও মানসিক দূরত্ব ঠিকই থেকে যায় প্রবাসীদের সাথে দেশে অবস্থানরত পরিবার পরিজনের। অধিকাংশ প্রবাসী নিয়মিত দেশে আসতে পারে না, নানাবিধ জটিলতা কিংবা আর্থিক অসঙ্গতির কারণে। খুব কম প্রবাসী আছে যারা প্রতিবছর দেশে আসে বা আসতে পারে। এমনও প্রবাসী আছে, যারা অর্ধযুগ পরও দেশে আসতে পারে না প্রবাসের প্রতিকূলতা পেরিয়ে।

অনেকেই আবার নিয়মিত যোগাযোগও সবসময় করতে পারে না।

যোগাযোগের এই ঘাটতি, নিজ পরিবার থেকে দীর্ঘদিনের বিচ্যুতি, মানসিক ও আবেগিক ভাব আদান-প্রদানের ব্যর্থতা, পরিবার-পরিজন কিংবা আত্মীয়-স্বজনের কোনো কাজে শারীরিক অনুপস্থিতি এবং আপনজনদের প্রতি নিজ দায়িত্ব-কর্তব্য যথাসময়ে সঠিকভাবে পালন করতে না পারার কারণে প্রবাসীদের সাথে দেশের পরিজনদের সৃষ্টি হয় মানসিক দূরত্ব এবং ভুল বুঝাবুঝির দেয়াল, যা অনেক ক্ষেত্রে তীব্র প্রভাব পড়ে প্রবাসীদের ব্যক্তিগত ও পারিবারিক জীবনে। জীবনে আর্থিক স্বচ্ছলতা আনয়ন, পরিবার-পরিজন তথা সন্তান-সন্তুতির উন্নত জীবন ধারণের ব্যবস্থা করতে গিয়ে প্রবাসে যুগের পর যুগ কাটিয়ে দিচ্ছে কোটি প্রবাসী। তাদের স্বপ্ন থাকে নিজেদের উপার্জিত অর্থের বিনিময়ে দেশে অবস্থানরত আপনজনরা ভালো থাকুক।

সন্তানরা পড়ালেখা করে মানুষের মতো মানুষ হোক, বৃদ্ধ মা-বাবা শেষ বয়সে একটু স্বাচ্ছন্দ্যে দিনাতিপাত করুক। কিন্তু এসব যোগান দিতে গিয়ে নিজের অজান্তেই হারিয়ে ফেলে ব্যক্তিজীবনের সকল প্রশান্তি। অনেক সময় জীবনে নেমে আসে ঘোর অন্ধকার। যাদের জন্য দিনরাত পরিশ্রম করছে, তারা কোন কারণে ভুল বুঝে বসে থাকে অথবা নিজে ঠিকমতো অর্থের যোগান দিতে না পারায় পরিবার-পরিজন নারাজ হয়ে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে এবং খারাপ আচরণ করে প্রবাসীদের সাথে।

তাদের উপরের দায়িত্ব, চাপ ও তাদের ভাবনা

প্রবাসী মানেই মনে করা হয়, টাকার গাছ! মাস শেষে মোটা অংকের টাকা পাঠানোই যেন তাদের কাজ। কোনো কারণে টাকা পাঠাতে না পারলেই শুরু হয় বিপত্তি। বেঁকে বসে সব আপনজন। আবার এর উল্টো পিঠে দেখা যায়, আর্থিক স্বচ্ছলতার সুযোগে নিজের পরিবার উচ্ছন্নে যায়। আপনজনদের সাথে প্রবাসীর ভৌগোলিক দূরত্বের কারণে সন্তানদের বা অনুজদের আদর-সোহাগ দেয়া বা শাসন করা কোনটাই হয়ে ওঠে না। ছেলে সন্তান, মা-বাবা বা আপনজনদের সাথে বসবাস করলে পারস্পরিক যে সহমর্মিতা, সহনশীলতা, আন্তরিকতা, শ্রদ্ধাবোধ এবং পারিবারিক শিক্ষা গড়ে ওঠে দীর্ঘদিন প্রবাসে থাকার ফলে সন্তান বা নিজ পরিবার এসব থেকে বঞ্চিত হয় এবং সম্পর্কটা হয়ে উঠে অনেকটা আনুষ্ঠানিক বা সৌজন্যের।

প্রবাসীদের স্ত্রী কিংবা সন্তানরা সহজে প্রবাসী স্বামী কিংবা বাবার সিদ্ধান্ত মেনে নিতে চায় না। তাদের কাছে মনে হয়, এটি জোরারোপ করে চাপিয়ে দেয়ার মতো। বাবার কর্তৃত্ব সন্তানরা যেমন সহজে মানতে চায় না, তেমনি করে নিজ স্ত্রী বা পরিবারের অন্য সদস্যরাও সহজে মেনে নিতে চায় না। বিশেষ করে, সন্তানদের কাছে বাবা হয়ে উঠে অনেকটা বহিরাগত পরিচিতজনের মতো। এই যে মানসিক দূরত্ব কিংবা টানাপোড়েন এটি কিন্তু প্রবাসী ব্যতীত অন্যদের চোখে তেমন ধরা পড়ে না বা অন্যদের কাছে বিষয়টি সেভাবে মানে রাখে না। 

অধিকাংশ প্রবাসীর সন্তানেরা হয়ে পড়ে ‘মা’ নির্ভর। বাবাকে তারা দুই বছর তিন বছর পর কয়েক মাসের জন্য পায় মাত্র। বাকি সময়ের সকল কিছু যোগান দেয় তাদের মা। শিশুরা খুব ছোটকাল থেকেই যে কোনো সম্পর্ক গড়ে তোলার ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ যোগাযোগ, স্পর্শ প্রাধান্য দিয়ে থাকে। তাই শিশুদের কাছাকাছি বা সংস্পর্শে যারা থাকে তাদের প্রতি নির্ভরশীলতা বেড়ে যায়। তাই মায়ের সাথেই তাদের সব সম্পর্ক বা আবেগ অনুভূতি। 

অপরদিকে প্রবাসীদের স্ত্রীরাও সন্তানের লালন-পালন, পরিবারের অন্যান্য আনুষাঙ্গিক কাজকর্ম, আত্মীয়-স্বজনের সম্পর্ক রক্ষা করা বিপদ-আপদে উপস্থিত হওয়াসহ নানান কাজে প্রচন্ড মানসিক চাপে ভোগে। মানসিক এই চাপের কারণে অনেক সময় ঝগড়া বা ভুল বুঝাবুঝির সৃষ্টি হয় স্বামী বা শশুর-শাশুড়ি বা দেবর-ভাসুরের সাথে। এই ভুল বুঝাবুঝি এক সময় বড় আকার ধারণ করে, সংসারের অশান্তি সৃষ্টি করে।

স্ত্রী তার প্রবাসী স্বামীকে বলে এককথা আর মা-বাবা বা ভাইবোন বলে অন্য কথা। অন্যদিকে প্রবাসী বেচারা প্রবাসজীবনের নানান প্রতিকূলতার মাঝে পারিবারিক এই দ্বন্দ্বের কারণে ঠিক মতো কাজে মনযোগ দিতে পারে না, ঘুমাতেও পারে না ঠিক মতো। স্ত্রীকে কিছু বলতে পারে না আর মা-বাবাকেও কিছু বললে সমস্যা।

শ্যাম রাখে না কূল রাখে এই অবস্থার মধ্যে প্রবাসীদের বিষণ্ন সময় কাটে। সমস্যা কিন্তু এখানেই শেষ নয়। প্রবাসীদের সন্তানদের পড়ালেখা, নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রাদি খরিদ, বিনোদনের ব্যবস্থা, রোগে-শোকে দেখভাল করার মতো কেউ থাকে না। যৌথ পরিবারে বসবাস করলেও বাড়ির অন্যান্য সদস্য প্রবাসীদের পরিবারের প্রতি শতভাগ মনযোগ দেয় না বা দেয়াটা সবসময় হয়ে ওঠে না। এটার বহুবিধ যৌক্তিক কারণও রয়েছে অবশ্যই।

তাছাড়া নারীদের এমন কিছু প্রয়োজনীয়তা বা সমস্যা থাকে, যা স্বামী ব্যতীত কারো সাথে শেয়ার করা সম্ভব না। সব মিলিয়ে প্রবাসীদের স্ত্রীরা অনেক সময় তার পাশে কাউকে খুঁজে নেয় যে কীনা তার কাজ-কর্মে সাহায্য করবে। হতে পারে সে কোনো নিকটআত্মীয়, বন্ধু, প্রতিবেশী বা অন্য কেউ।

তখন ঐ ব্যক্তির সাথে বিভিন্ন কাজেকর্মে কথা হয়, দেখা হয় বা সাথে বাইরেও যেতে হয় অনেক সময় এবং এটি করতে গিয়ে এক সময় সম্পর্কে আস্থা ও গভীরতা চলে আসে এবং ভুলে যায় তাদের পারিবারিক ও নৈতিক অবস্থানের কথা। মোবাইলে চলে অভিসার। স্বামীর অনুপস্থিতি, দীর্ঘদিনের ভালোবাসা বঞ্চিত মনে নতুন করে সৃষ্টি হয় প্রেমাসক্তি। একদিকে স্বামীর কাছ থেকে আর্থিক সুযোগ-সুবিধা গ্রহণ করে অন্যদিকে অনৈতিক সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে, যার ফলে একসময় পরিবারে নেমে আসে অন্ধকার এবং প্রায় ক্ষেত্রে ভেঙ্গে যায় সাজানো সংসার, ধুলোয় মিশে যায় একজন প্রবাসীর তিলে তিলে গড়ে তোলা সংসার এবং নষ্ট হয় তার আগামী প্রজন্ম।

 যে প্রবাসীর জীবনে এমন ছন্দপতন ঘটে তার জীবনে আর ছন্দ ফিরে আসে না। সামাজিকভাবে হতে হয় হেয় প্রতিপন্ন, আত্মীয়স্বজনসহ সকলের কাছে নিজের ভার্বমর্যাদা নষ্ট হয় এবং সন্তানদের জীবনেও নেমে আসে অনিশ্চয়তার প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়। তা ছাড়াও আরো ভিন্ন চিত্রও রয়েছে প্রবাসীদের জীবনে। একজন প্রবাসী তার কষ্টার্জিত অর্থ দেশে বাবা, ভাই কিংবা স্ত্রীর নামে পাঠিয়ে নিশ্চিন্তে থাকে যে, তাদের অর্থ আপনজনরা কখনো অপচয় করবে না বা নষ্ট করবে না। অনেক সময় দেখা যায়, তার টাকা দিয়ে জায়গা জমি কিনেছে। অথচ, তার নাম নেই অথবা তার একার নামে না কিনে পরিবারের সকল সদস্যের নামে কিনেছে। 

অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, তার সব অর্থ মা-বাবা, ভাই-বোন অথবা স্ত্রী আয়েশি জীবনের পিছনে খরচ করে ফেলেছে। অথবা দেখা গেছে, প্রবাসী ভাইটি নিজের সকল আয় রোজগার মা-বাবা, ভাই-বোনকে বাদ দিয়ে নিজ স্ত্রীর কাছে জমা রেখেছে পরম বিশ্বাসে, আর তার স্ত্রী প্রবাসী স্বামীর সরলতার সুযোগে একাউন্টে থাকা সকল টাকা পয়সা নিয়ে অন্যের হাত ধরে চলে গেছে আপাত সুখের স্বপ্নরাজ্যে! প্রবাসে অবস্থানরত মানুষটি যখন এসব জানতে পারে, তখন তার আর কী-ই বা করার থাকে! নিঃস্ব হয়ে মুষড়ে পড়ে, জীবনের প্রতি বিতৃষ্ণা চলে আসে, সামনে এগিয়ে যাবার সামর্থ হারিয়ে ফেলে। এ নিয়ে কাউকে কিছু বললে বেড়ে যায় বিড়ম্বনা, তীব্র হয় সম্পর্কের অবনতি। অনেক সময় অনেক প্রবাসীর অকাল মৃত্যু ডেকে আনে এসব পরিস্থিতি।

দেশে প্রবাসীদের গুরুত্ব

আমাদের দেশের কথা যদি আমি বলি তবে বলব যে, আমাদের দেশে প্রবাসীদের কোনো গুরুত্ব নেই, আছে অবহেলা। একজন প্রবাসী দেশের জন্য কাজ করতে গিয়েও যতটুকু অবহেলা সহ্য করে আত্মসম্মানের বোধ ত্যাগ করে কাজ করে সেটা আসলে আমাদের এই দেশ কখনোই বোঝেনি বা বোঝার চেষ্টা করেছে বলে তা ততটা স্পষ্ট মনে হয় না আমার কাছে কারণ আমার কাছে আমাদের দেশে প্রবাসীদের মূল্য শূন্য। কেন এমন তা হয়তো আমার জানা না থাকলেও জানা আছে সরকার কিংবা সরকারের উচ্চপদস্থ নেতাদের।

আমাদের দেশে যে হারে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে প্রবাসীরা যদি দেশ ত্যাগ করে না যেত তাহলে দেশ আর দেশের মতো থাকত না। দেশ বৃন্দাবনে চলে যেত। ব্যাপারটা অনেকটা হাস্যকর মনে হলেও তা সত্য।

শেষ কথা

প্রবাসে থাকা মানুষটির বিন্দু বিন্দু ঘামে হাসি ফুটায় দেশে থাকা চার-পাঁচ কোটি মানুষের মুখে। এই প্রবাসীদের আজ ও আগামীর জন্য আমাদের সুদূরপ্রসারী ভাবনা কী? একজন মানুষ দেশের সীমানা পাড়ি দেয়ার সঙ্গে সঙ্গেই হয়ে যায় বিদেশি, গায়ে লেগে যায় ‘প্রবাসী’ তকমা। স্বদেশি-প্রবাসী ভাগাভাগি করতে গিয়ে সামনে দাঁড়িয়ে যায় বিভাজনের এক দেয়াল। 

তার দেশপ্রেমেও সন্দেহ খুঁজে পায় দেশের মানুষ। ঠিক তেমনি করে আপনজনও বিভিন্ন ক্ষেত্রে সন্দেহ করে। টাকা পয়সা নাই বললেও কখনো বিশ্বাস করে না। অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে প্রবাসে এক একটি দিন পার করে প্রবাসীরা আর ভাবে আর কতদূর এই পথ পরিক্রমা। প্রবাস শুধু প্রবাস নয়, এর আরেক নাম ‘নির্বাসন’। প্রবাসে আর যা-ই থাকুক মানসিক প্রশান্তি নেই, আছে কেবল দুঃখ, বেদনা আর দীর্ঘশ্বাস!

প্রবাসীর কষ্ট প্রবাসী ছাড়া আর কেউ বোঝে না। অনুমান করে সব কষ্ট বোঝা যায় না। প্রবাসীরা ভালো থাকুক। প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্সেই আমাদের অর্থনীতির চাকা হয় বেগবান। আমরা সমৃদ্ধির পথে এগোচ্ছি। সম্মান করা উচিত সব প্রবাসী ভাইদের। আর কোনো প্রবাসী ভাই যেন দুঃশ্চিন্তা করে বিদেশের মাটিতে প্রাণ না হারায় সেই কামনা। ভালো থাকুক প্রবাসীরা।

About Durud Ahmed

সম্মানিত ভিজিটর আমি দুরুদ আহমেদ,পেশায় আমি একজন ব্লগ লেখক। প্রযুক্তি ও শিক্ষা, ইতিহাস-ঐতিহ্য, লাইফস্টাইল এবং ইসলামিক লেখাই আমার প্রিয়। এই ব্লগের মাধ্যমে আমি সঠিক তথ্য প্রদানের মাধ্যমে ভিজিটরদের সহযোগিতা করাই মূল লক্ষ্য।