সেহরি ও ইফতারের দোয়া এবং রোজার নিয়ত 

রমজান মাস মুসলিম উম্মাহর কাছে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মাস। এই মাসে পবিত্র আল-কোরআন নাজিল করা হয়েছে। একে একে সাইয়্যিদুশ-শুহুর বা সকল মাসের সেরা মাসও বলা হয়। রমজান মাসে রোজা, সেহরি, ইফতার, সেহরি ও ইফতারের দোয়া ইত্যাদি ফজিলতপূর্ণ ইবাদত রয়েছে, যা আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভে সহায়ক।

রমজানে রোজাদারদের প্রত্যেক ইবাদতের সওয়াব ৭০ থেকে ৭০০ গুণ পর্যন্ত বৃদ্ধি করা হয়। দ্বীন ইসলামের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ এই রোজা। সেই রোজার গুরুত্বপূর্ণ বিধানগুলো সঠিকভাবে পালন করলে আমাদের ইবাদাতে পূর্ণতা আসবে এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করা যাবে। রমজান মাসের ফরজ রোজাসহ অন্যান্য মাসের নফল ও সুন্নত রোজায় সেহরি, ইফতারসহ বেশি বেশি দোয়া ও নেক আমল করা অনেক ফজিলতপূর্ণ। তাই সেহরি, ইফতারের দোয়া, আদব, নিয়ম ইত্যাদি বিষয়ে জেনে নিন এই লেখাতে।

রমজান মাস, সাওম, সেহরি ও ইফতারের গুরুত্ব

রমজান মাস সম্পর্কে মহান আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কোরআনে বিভিন্ন আয়াত নাজিল করেছেন। যথা যথা:

মহান আল্লাহ তা’আলা পবিত্র কোরআনে বলেন- “হে মুমিনগণ! তোমাদের জন্য রোজার বিধান দেওয়া হলো, যেমন দেওয়া হয়েছিলো তোমাদের পূর্ববর্তীগণকে; যাতে তোমরা তাকওয়া অর্জন করতে পারো।”

মহান আল্লাহ তা’আলা পবিত্র কুরআন মাজীদে আরো বলেছেন- “রমজান মাস, এতে মানুষের দিশারি এবং সৎ পথের স্পষ্ট নিদর্শন ও সত্যাসত্যের পার্থক্যকারী রূপে কোরআন অবতীর্ণ হয়েছে। সুতরাং তোমাদের মধ্যে যারা এই মাস পাবে, তারা যেনো সাওম পালন করে।” (সুরা বাকারাহ, আয়াত:১৮৫)

বস্তুত, রমজানে রোজাদারদের প্রত্যেক ইবাদতের সওয়াব বৃদ্ধি, জীবনের গুনাহ মাফ করে জাহান্নাম থেকে মুক্তি, রাইয়ান নামক দরজা দিয়ে জান্নাতে প্রবেশ ও আল্লাহর পক্ষ থেকে পুরস্কারের ঘোষণা রয়েছে। তাই সাওম, সেহরি ও ইফতারের গুরুত্ব অপরিসীম।

ইফতারের দোয়া

প্রাপ্তবয়স্ক মুমিন বান্দারা মহান আল্লাহ তায়ালা সন্তুষ্টির জন্য সূর্যাস্ত থেকে সূর্যোদয় পর্যন্ত নিজেদের যাবতীয় পানাহার ও জৈবিক চাহিদা থেকে বিরত থাকার মাধ্যমে রোজা বা সাওম পালন করেন। ইফতারের সময়টির রোজাদারদের জন্য একটি আনন্দঘন মুহূর্ত। সারাদিন পানাহার বন্ধ রেখে ইফতারের সময় আল্লাহর কাছে তার নেয়ামতের শুকরিয়া আদায় করা সুন্নত। মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) নিম্নোক্ত দোয়াটি পড়ার মাধ্যমে ইফতার শুরু করতেন:

আরবিতে দোয়া: بسم الله اَللَّهُمَّ لَكَ صُمْتُ وَ عَلَى رِزْقِكَ اَفْطَرْتُ

বাংলা উচ্চারণ: “বিস্-মিল্লাহি আল্লা-হুম্মা লাকা ছুমতু, ওয়া আলা রিযক্বিকা ওয়া আফ-তারতু।”

বাংলা অর্থ: “আল্লাহর নামে (শুরু করছি); হে আল্লাহ! আমি আপনারই সন্তুষ্টির জন্য রোজা রেখেছি এবং আপনারই দেয়া রিজিক দ্বারা ইফতার করছি। (আবু দাউদ, হাদিস: ২৩৫৮)

ইফতারের পর যে দোয়া পড়তে হয়

হজরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রাঃ) থেকে বর্ণিত- 

রাসুলুল্লাহ (সাঃ) -ইফতার করাকালীন সময়ে বলতেন:

আরবি: ذَهَبَ الظَّمَاءُ وَابْتَلَتِ الْعُرُوْقُ وَ ثَبَتَ الْأَجْرُ اِنْ شَاءَ اللهُ

বাংলা উচ্চারণ: “জাহাবাজ্ জামাউ, ওয়াব-তালাতিল উ’রুকু, ওয়া ছাবাতাল আঝরু ঈন-শা-আল্লাহ।”

বাংলা অর্থ: “পিপাসা দূর হলো (ইফতার দ্বারা), শিরা-উপশিরা সিক্ত হলো এবং আল্লাহ চাইলে সাওয়াবও নিশ্চিত হলো।” (আবু দাউদ, হাদিস: ২৩৫৭)

ইফতারের সময় করনীয় ও আদব সমূহ 

প্রতিটি মুসলিমের জন্য ইফতারের সময়টি যেমন আনন্দের, তেমনি অধিক সওয়াব অর্জনের জন্য উপযুক্ত সময়। সুর্যাস্তের সঙ্গে সঙ্গে দ্রুত ইফতার করা যেমন সুন্নত ও বরকতময়। বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) -বহুবার নানা হাদিসের মাধ্যমে যথাসময়ে ইফতার করার জন্য বিশেষভাবে তাগিদ দিয়েছেন। তিনি বলেছেন- “মানুষ যতদিন ইফতারের সময় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বিলম্ব না করে ইফতার করবে, ততদিন তারা করলেন লাভ করবে।” (বুখারি শরিফ, হাদিস: ২৮৫২)

ইফতারের সময় রোজাদারদের কিছু আদব ও করনীয় বিষয়বস্তু রয়েছে। এগুলো হলো:

  • ইফতারের কিছু সময় আগে ইফতারি (খাবার) সামনে নিয়ে বসে বসে তাসবিহ-তাহলিল, তাওবাহ-ইসতেগফার, দোয়া-দরূদ পড়ার মাধ্যমে সময় অতিবাহিত করা। 
  • ইফতারের আগ মুহূর্ত থেকে ইফতার করার সময় আল্লাহ তাআলা বান্দার যে কোনো দোয়া কবুল করেন, তাই এই সময় বেশি বেশি দোয়া করা ও ক্ষমাপ্রার্থনা করা।
  • যথা সময়ে সূর্যাস্তের সাথে সাথে ইফতার করা।
  • খেজুর, সাদা পানি কিংবা দুধ দিয়ে ইফতার শুরু করা এবং যথাসময়ে মাগরিবের নামাজ জামাতে পড়া।
  • ইফতারের সময় অন্য কাজে ব্যস্ত না হয়ে, মনোযোগ সহকারে আল্লাহর নেয়ামত ভক্ষণ করা।
  • ইফতারের সময় ভারী খাবার না খাওয়া বা বেশি না খাওয়া।
  • ইফতারে বিলম্ব করে মাগরিব নামাজের জামাত তরক না করা।

নামাজের পূর্বে ভারী খাবার খেলে নামাজে অলসতা আসতে পারে এবং হঠাৎ ভারী খাবার খেলে শরীরে নানান প্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে। মাগরিবের নামাজ জামাতের সাথে সম্পূর্ণরূপে আদায় করার পর রোজাদার ব্যক্তিরা পুনরায় তৃপ্তি সহ পরিমাণমতো খাবার খেতে পারবে। এতে করে, শরীর সবল লাগে এবং পরিপূর্ণ আমেজে ইবাদত করা যায়।

সেহরির নিয়ত ও সেহরির দোয়া 

রোজা রাখার উদ্দেশ্যে সুবহে সাদিকের পূর্বে শেষ রাতের খাবার বা পানাহারকেই ‘সেহরি’ বা ‘সাহরি’ বলা হয়। রমজানের গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত ইফতার ও সেহরি। সুর্যাস্তের সাথে সাথে ইফতার করা যেমন সুন্নত ও বরকতময়, তেমনি রাতের শেষ ভাগে নির্দিষ্ট সময়ের পূর্বে সেহরি খাওয়াও সুন্নাত এবং কল্যাণের। সেহরির জন্য আলাদা বা নির্দিষ্ট কোনো নিয়ত নেই। 

তবে শেষ রাতে পানাহারের সময় খাবারের দোয়া পড়া সুন্নত। সেহরি খাওয়ার সময় অন্যান্য বেলার খাবারের মতোই দোয়াগুলো পড়তে হয়:

সেহরি খাবার শুরুর দোয়া

মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) – সেহরি সহ অন্যান্য সময়ের খাবার শুরু করার পূর্বে নিম্নোক্ত দোয়াটি পড়তেন:

আরবি: بسم الله وعلى بركة الله

বাংলা উচ্চারণ: “বিস-মিল্লাহি ওয়া-আলা বারকাতিল্লাহ।” (সাআলাবী)

দোয়ার বাংলা অর্থ: “আল্লাহ তা’আলার নামে খাওয়া শুরু করছি এবং আল্লাহর বরকত প্রার্থনা করছি।” 

সেহরি খাবার আগে দোয়া পড়তে ভুলে গেলে যে দোয়া পড়তে হয়

সেহরি সহ অন্যান্য সময় খাবার শুরু করার আগে কেউ বিসমিল্লাহ বলতে ভুলে গেলে বা খাবার শুরুর দোয়া না পড়লে, খাবার মাঝখানে পরবর্তীতে মনে হলে অন্য একটি দোয়া পাঠ করতে হয়। দোয়াটি হলো:

আরবি: بسم الله اوله واخره

বাংলা উচ্চারণ: “বিস-মিল্লাহি আওয়ালাহু ওয়া আখেরাহ্।” (আবু দাউদ, মুসনাদে আহমদ)

বাংলা অর্থ: “মহান আল্লাহ তা’আলার নামে খাওয়া শুরু করছি। আদিতে (প্রথমেও) মহান আল্লাহর নাম, অন্তেও (শেষেও) মহান আল্লাহর নাম।”

এভাবে দোয়া পাঠ করে মহান আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করার মাধ্যমে খাবারের আদব-কায়দা মেনে সেহরি খাওয়া আল্লাহর কাছে পছন্দনীয়।

রোজার নিয়ত

মুমিন বান্দার প্রতিটি ইবাদতের সাথে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে নিয়তের বিষয়টি জড়িত। নিয়ত মানে হলো ইচ্ছা পোষণ করা। প্রকৃতপক্ষে নিয়ত মানুষের অন্তরের সাথে সম্পৃক্ত। মানুষ কোন কাজ করার পূর্বে সেই কাজ সম্পর্কে যা নিয়ত করবে, সে তেমনি প্রতিদান পাবে।

সাধারণত আমাদের দেশের নিয়ত মুখে পাঠ করা হয়। কিন্তু মুখে পাঠ করার চেয়ে অন্তর থেকে দৃঢ়ভাবে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য নিয়ত করার অধিক গুরুত্বপূর্ণ। রোজা রাখার জন্য বাংলাদেশে রোজার নিয়ত হিসেবে একটি আরবি নিয়ত প্রচলিত আছে। কোন হাদিস ও ফিকাহের কিতাবে এই নিয়ত বর্ণিত হয়নি। আরবি এই নিয়তটি হলো:

রোজার নিয়ত আরবি: نَوَيْتُ اَنْ اُصُوْمَ غَدًا مِّنْ شَهْرِ رَمْضَانَ الْمُبَارَكِ فَرْضَا لَكَ يَا اللهُ فَتَقَبَّل مِنِّى اِنَّكَ اَنْتَ السَّمِيْعُ الْعَلِيْم 

রোজার নিয়তের বাংলা উচ্চারণ: “নাওয়াইতু-আন আছুমা গাদাম, মিন শাহরি রমাদানাল মুবারাক; ফারদাল্লাকা ইয়া আল্লাহু, ফাতাকাব্বাল মিন্নি ইন্নিকা আন-তাস সামিউল আলিম।”

রোজার আরবি নিয়তের বাংলা অর্থ: “হে আল্লাহ! আমি আগামীকাল পবিত্র রমজানের আপনার পক্ষ থেকে নির্ধারিত ফরজ রোজা রাখার ইচ্ছা পোষণ (নিয়ত) করলাম। অতএব, তুমি আমার পক্ষ থেকে (আমার রোযা) কবুল কর, নিশ্চয়ই তুমি সর্বশ্রোতা ও সর্বজ্ঞানী।”

রোজার নিয়ত বাংলায়

যেকোনো ইবাদতের গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ হচ্ছে নিয়ত করা। সঠিকভাবে অর্থবহ নিয়ত করা/ প্রকৃতভাবে ইচ্ছা পোষণ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু আমরা অধিকাংশ ক্ষেত্রে আরবি ভাষায় নিয়ত করে থাকি। তাই অনেকেরই আরবি নিয়তের উচ্চারণে ভুল হয়ে নিয়তের অর্থ বিকৃত হতে পারে। মহান আল্লাহ তা’আলা নিয়তের ক্ষেত্রে বান্দার মনের অবস্থা দেখবেন।

এক্ষেত্রে নিয়তের বিষয়টিকে এতটা কঠিন না করে, আমরা নিজের মাতৃভাষা বাংলায় রোজার নিয়ত করতে পারি। বাংলা ভাষায় নিম্নোক্তভাবে রোজার নিয়ত করা যায়:

“হে আল্লাহ! আমি আপনার সন্তুষ্টির জন্য আজ রোজা রাখার নিয়ত করলাম।”

আরও পড়ুন: আল্লাহর বাণী, হাদিস এবং বিখ্যাত মনীষীদের ইসলামিক উক্তি

এছাড়াও আপনি আরও সহজভাবে ইবাদতের প্রতি নিজের মনস্তাত্ত্বিক অবস্থা তুলে ধরে নিয়ত সম্পন্ন করতে পারেন।

শেষকথা

উপরোক্ত আলোচনা থেকে আমরা ইফতারের দোয়া, সেহরির দোয়া, রোজার নিয়ত সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে পারলাম। মহান আল্লাহ তা’আলা মুসলিম উম্মাহকে ইফতারের আগে তাওবা-ইসতেগফার করা, ইফতারের দোয়া করা এবং রমজান মাসের যাবতীয় আমল সঠিকভাবে করার তাওফিক দান করুক, আমিন।

Scroll to Top