জসীম উদ্দীন এর উক্তি

জসীম উদ্দীন এর উক্তি ও কবিতা

আজ আমরা আপনাদের জন্য হাজির হলাম জসীম উদ্দীন এর উক্তি কবিতা নিয়ে। জসীম উদ্দীন সারাটা জীবন পল্লীর মানুষ নিয়ে চিন্তা করতেন। তাই তাঁর বেশির ভাগ লেখনিতে পল্লীর বিষয় উল্লেখ। আশা করি এই পল্লী কবির উক্তিকবিতা গুলো আপনাদের অনেক ভালো লাগবে। তাহলে চলুন এবার শুরু করা যাক।

জসিম উদ্দীন

জসীম উদ্দীন (Josim Uddin) একজন বিখ্যাত বাঙালি কবি। তাঁর পুরো নাম জসীম উদ্দীন মোল্লা। তিনি বাংলাদেশে পল্লী কবি হিসেবে পরিচিত। তার লেখা কবর কবিতাটি বাংলা সাহিত্যে এক অনন্য অবদান। তিনি ১৯০৩ সনের পহেলা জানুয়ারি ফরিদপুর জেলার তাম্বুলখানা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।

জসীম উদ্দীন একজন বাঙালি কবি, গীতিকার, ঔপন্যাসিক ও লেখক। ‘পল্লীকবি’ উপাধিতে ভূষিত, জসীম উদ্দীন আবহমান বাংলার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যে লালিত প্রথম পূর্ণাঙ্গ আধুনিক কবি। ঐতিহ্যবাহী বাংলা কবিতার মূল ধারাটিকে নগর সভায় নিয়ে আসার কৃতিত্ব জসীম উদ্দীনের। তার নকশী কাঁথার মাঠ ও সুজন বাদিয়ার ঘাট বাংলা ভাষার গীতিময় কবিতার উৎকৃষ্টতম নিদর্শনগুলোর অন্যতম। তার কবিতা বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়েছে। তার লেখা অসংখ্য পল্লিগীতি এখনো গ্রাম বাংলার মানুষের মুখে মুখে শোনা যায়। যথা- আমার হার কালা করলাম রে, আমায় ভাসাইলি রে, বন্ধু কাজল ভ্রমরা রে ইত্যাদি।
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শিক্ষিত জসীম উদ্দীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ৫ বছর শিক্ষকতা করেন ১৯৪৪ সালে শিক্ষকতা ছেড়ে তিনি বঙ্গীয় প্রাদেশিক সরকার এবং পরে পূর্ব পাকিস্তান সরকারের প্রচার বিভাগের কর্মকর্তা হিসেবে যোগদান করেন। এবং ১৯৬২ সালে অবসর গ্রহণ করেন। জসীম উদ্দীন ছিলেন প্রগতিশীল ও অসাম্প্রদায়িক চেতনার অধিকারী এবং সমাজতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার একজন দৃঢ় সমর্থক। তিনি ছিলেন পূর্ব পাকিস্তানের সাংস্কৃতিক আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা।
জসীম উদ্দীন প্রেসিডেন্টের প্রাইড অব পারফরমেন্স পুরস্কার (১৯৫৮), বাংলাদেশ সরকারের একুশে পদক (১৯৭৬) ও স্বাধীনতা পুরস্কারে (মরণোত্তর, ১৯৭৮) ভূষিত হন। তিনি ১৯৭৪ সালে বাংলা একাডেমী সাহিত্য পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করেন।

তিনি ১৩ মার্চ ১৯৭৬ সনে ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন। পরে তাকে তার নিজ গ্রাম বিমলগুহে সমাধিস্থ করা হয়।

জসীম উদ্দীন এর উক্তি

জসীম উদ্দীন এর উক্তি

পল্লীর জনগন নিয়ে ভাবনা করা কবির নাম কি আপনার মনে আছে? বলুন তো তিনি কে ছিলেন? আমার সাথে একমত হয় তো সবাই এই কবির নাম আপনার মনে আসতেছে যে, জসীম উদ্দীন। তাই নয় কি? চলুন উনার রেখে যাওয়া উক্তি গুলো পড়ে নিই।

তুমি যাবে ভাই?
যাবে মোর সাথে,
আমাদের ছোট গাঁয়?
গাছের ছায়ায় লতায় পাতায়
উদাসী বনের বায়?

ওই দূর বনে সন্ধ্যা নামিছে ঘন আবীরের রাগে অমনি করিয়া লুটায়ে পড়িতে বড় সাধ আজ জাগে।

আমাদের দেশের লোকেরা যেমন ভুত, প্রেত,
ওঝা পীর ও ফকিরে বিশ্বাস করে তেমনি হোমিওপ্যাথিক ঔষধে বিশ্বাস করে।

আমার এ ঘর ভাঙিয়াছে যেবা,
আমি বাঁধি তার ঘর,
আপন করিতে কাঁদিয়া বেড়াই
যে মোরে করেছে পর।

ওই দূর বনে সন্ধ্যা নামিছে ঘন আবীরের রাগে অমনি করিয়া লুটায়ে পড়িতে বড় সাধ আজ জাগে।

এই খানে তোর দাদির কবর ডালিম-গাছের তলে,
তিরিশ বছর ভিজায়ে রেখেছি দুই নয়নের জলে।
এতটুকু তারে ঘরে এনেছিনু সোনার মতন মুখ,
পুতুলের বিয়ে ভেঙে গেল বলে কেঁদে ভাসাইত বুক।
এখানে ওখানে তারপর এই শূন্য জীবনে যত কাটিয়াছি পাড়ি
যেখানে যাহারে জড়ায়ে ধরেছি সেই চলে গেছে ছাড়ি।

গত ওহাবি আন্দোলনে যখন দেশের মাওলানারা এদেশ হইতে ইংরেজ তাড়ানো অসম্ভব জানিলেন,
তখন তাঁহারা দেশের অশিক্ষিত অর্ধশিক্ষিত গুণী ব্যক্তিদের উপর যে অমানুষিক অত্যাচার করিয়াছিলেন তাহার ফলে আজ আমাদের সমাজে বড় সাহিত্যিক নাই;
বড় চিত্রশিল্পী নাই-
বড় সুরশিল্পী নাই।
আমাদের মুসলিম সমাজে এই অনাচার আর কতদিন চলিবে?

আমাদের দেশের লোকেরা যেমন ভুত, প্রেত,
ওঝা পীর ও ফকিরে বিশ্বাস করে তেমনি হোমিওপ্যাথিক ঔষধে বিশ্বাস করে।
এ দেশের লোক সব সময়ই কিছু বিশ্বাস করিবার জন্য প্রস্তুত হইয়া থাকে।
যাহারা হোমিওপ্যাথিকে বিশ্বাস করে তাহারা বন্ধু সমাবেশে এই ঔষধের কার্যকারিতা সম্বন্ধে এমন সব রোমাঞ্চকর কাহিনী বানাইয়া বলে যে শ্রোতাদের মধ্যে কেউ যদি তাহা অবিশ্বাস করিতে চায়,
তাহার পক্ষে সেখানে তিষ্ঠান দায় হইয়া পড়ে।
সে গল্প যাহারা শোনে তাহারা আবার তাহাতে আরও কিছু রঙ চড়াইয়া অপরের কাছে বলে।

পার্থক্যের জন্যই মানুষ মানুষের বন্ধু হয়।
আমার ভিতরে যাহা নাই তাই
আমরা অপরের নিকটে পাইয়া তাহার সঙ্গে বন্ধুত্ব করি।

সে মোরে দিয়েছে বিষ ভরা বান,
আমি দেই তারে বুক ভরা গান।

যে মোরে করিল পথের বিবাগী,
পথে পথে আমি ফিরি তার লাগি।

হিজলের বনে, ফুলের আখরে, লিখিয়া রঙিন চিঠি,
নিরালা বাদলে ভাসাইয়া দিয়াছে, না জানি কোন দিঠি।

মিথ্যা হৌক- সত্য হৌক মানুষ যে- কোনো বস্তু লইয়াই বিশ্বাস স্থাপন করুণ না কেন,
অত্যাচার করিয়া, পীড়ন করিয়া কেহ তাহাকে সি বিশ্বাস হইতে টলাইতে পারে না।

ধর্ম যখন রটিনমাফিক প্রথা হইয়া জীবনে অভ্যস্ত হইয়া যায় তখন তাহা হইতে কোনো উপকারই পাওয়া যায় না।

আমারে ছাড়িয়া এত ব্যথা যার কেমন করিয়া হায়,
কবর দেশেতে ঘুমায়ে রয়েছে নিঝঝুম নিরালায়!

এই যে তোমাকে দেখিয়া আমার ভালো লাগে,
এটাই কি কম লাভ?
জীবনে ভালো লাগিবার লোক কোটিতে গুটিক মেলে।

এদিকে দিগন্তে যতদূর চাহি,
পাংশু মেঘের জাল
পায়ে জড়াইয়া পথে দাড়ায়েছে,
আজিকার মহাকাল।

তারপর এই শূন্য জীবনে যত কাটিয়াছি পাড়ি
যেখানে যাহারে জড়ায়ে ধরেছি সেই চলে গেছে ছাড়ি।

শিশুদের মতো বৃদ্ধলোকদের দেহেও এক সুন্দর শোভা বিস্তার করে। কত বৃদ্ধের মধ্যে সেই শোভা দর্শন করিয়া মুগ্ধ হই।

সকল দুঃখেরই শেষ হয়। কিন্তু তাহার দাগ অন্তর হইতে মোছে না।

কোনো ভালো লোকের নামে কেহ কুৎসা রটাইলে লোকে সহজেই তাহা বিশ্বাস করে।

যুক্তি ছাড়িয়া যেখানেই কেহ শক্তির দম্ভে অপরকে নত করিয়ে যায়, সাময়িকভাবে ইহাতে কিছুটা সাফল্য দেখা গেলেও সে সাফল্য শুধু বালুর উপরে লেখন লেখা, অল্প দিনেই মুছিয়া যায়।

ভয়কে যেমন মানুষ এড়াইয়া চলিতে চায়, ভয়কে তেমনি মানুষ উপভোগও করে।

মানুষ কার কি দেখিয়া যে ভোলে তা বিধাতারও অগোচর!

আজিকার এই অভাবভরা নিরানন্দ দেশের সঙ্গে নানা কুসংস্কারপূর্ণ ধনধান্যে আনন্দগানে ভরা দেশকে আমি সহজেই বিনিময় করিতে পারিলে আনন্দে নাচিয়া উঠিতাম।

অত্যাধিক দরিদ্র্য মানুষের মনকে কত যে সংকীর্ণ করিয়া দেয়।

আমাদের সুন্দর সুন্দর আরও পোষ্ট পড়তে:

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের উক্তি, বাণী, কবিতার ক্যাপশন ও কবিতা

কাজী নজরুল ইসলাম এর সেরা কিছু বাণী বা উক্তি ও কবিতা

সুন্দর ফেসবুক স্ট্যাটাস, উক্তি, ক্যাপশন, কবিতা, কিছু কথা ও ছন্দ

রবি মিনিট চেক করার নিয়ম ২০২৪ | রবি মিনিট চেক কোড

অবাক করা ফেসবুক স্ট্যাটাস, উক্তি, ক্যাপশন, কবিতা ও কিছু কথা

সিঙ্গেল ফানি স্ট্যাটাস, ক্যাপশন, কবিতা ও কিছু কথা

বসন্তের রোমান্টিক স্ট্যাটাস, ক্যাপশন, উক্তি, ছন্দ ও কবিতা

সাদামাটা জীবন নিয়ে উক্তি, স্ট্যাটাস, ক্যাপশন, কবিতা ও কিছু কথা

জসীম উদ্দীন এর কবিতা

এমন এক ব্যক্তি যিনি তাঁর সারাটি জীবন ব্যয় করে গেছেন পল্লী দুঃখী জনগন নিয়ে লেখনির মাধ্যমে। আজ তাঁর কিছু সেরা সেরা কবিতা আপনাদের সাথে শেয়ার করবো। তাই চলুন জসীম উদ্দীনের সেই সব সেরা কবিতা গুলো পড়ে নি।

কবর

জসীমউদ্দীন

এই খানে তোর দাদির কবর ডালিম-গাছের তলে,
তিরিশ বছর ভিজায়ে রেখেছি দুই নয়নের জলে।
এতটুকু তারে ঘরে এনেছিনু সোনার মতন মুখ,
পুতুলের বিয়ে ভেঙে গেল বলে কেঁদে ভাসাইত বুক।
এখানে ওখানে ঘুরিয়া ফিরিতে ভেবে হইতাম সারা,
সারা বাড়ি ভরি এত সোনা মোর ছড়াইয়া দিল কারা!
সোনালি ঊষার সোনামুখ তার আমার নয়নে ভরি
লাঙল লইয়া খেতে ছুটিলাম গাঁয়ের ওপথ ধরি।

যাইবার কালে ফিরে ফিরে তারে দেখে লইতাম কত
এ কথা লইয়া ভাবি-সাব মোরে তামাশা করিত শত।
এমনি করিয়া জানি না কখন জীবনের সাথে মিশে
ছোট-খাট তার হাসি ব্যথা মাঝে হারা হয়ে গেনু দিশে।
বাপের বাড়িতে যাইবার কাল কহিত ধরিয়া পা
আমারে দেখিতে যাইও কিন্তু উজান-তলীর গাঁ।
শাপলার হাটে তরমুজ বেচি পয়সা করি দেড়ী,
পুঁতির মালার একছড়া নিতে কখনও হত না দেরি।

দেড় পয়সার তামাক এবং মাজন লইয়া গাঁটে,
সন্ধাবেলায় ছুটে যাইতাম শ্বশুরবাড়ির বাটে!
হেস না¬ হেস না¬ শোন দাদু, সেই তামাক মাজন পেয়ে,
দাদি যে তোমার কত খুশি হত দেখিতিস যদি চেয়ে!
নথ নেড়ে নেড়ে কহিত হাসিয়া, এতদিন পরে এলে,
পথ পানে চেয়ে আমি যে হেথায় কেঁদে মরি আঁখিজলে।
আমারে ছাড়িয়া এত ব্যথা যার কেমন করিয়া হায়,
কবর দেশেতে ঘুমায়ে রয়েছে নিঝঝুম নিরালায়!

হাত জোড় করে দোয়া মাঙ দাদু, আয় খোদা! দয়াময়,
আমার দাদীর তরেতে যেন গো ভেস্ত নসিব হয়।
তারপর এই শূন্য জীবনে যত কাটিয়াছি পাড়ি
যেখানে যাহারে জড়ায়ে ধরেছি সেই চলে গেছে ছাড়ি।
শত কাফনের, শত কবরের অঙ্ক হৃদয়ে আঁকি,
গণিয়া গণিয়া ভুল করে গণি সারা দিনরাত জাগি।
এই মোর হাতে কোদাল ধরিয়া কঠিন মাটির তলে,
গাড়িয়া দিয়াছি কত সোনামুখ নাওয়ায়ে চোখের জলে।

মাটিরে আমি যে বড় ভালবাসি, মাটিতে মিশায়ে বুক,
আয়-আয় দাদু, গলাগলি ধরি কেঁদে যদি হয় সুখ।
এইখানে তোর বাপজি ঘুমায়, এইখানে তোর মা,
কাঁদছিস তুই? কী করিব দাদু! পরাণ যে মানে না।
সেই ফালগুনে বাপ তোর এসে কহিল আমারে ডাকি,
বা-জান, আমার শরীর আজিকে কী যে করে থাকি থাকি।
ঘরের মেঝেতে সপটি বিছায়ে কহিলাম বাছা শোও,
সেই শোওয়া তার শেষ শোওয়া হবে তাহা কী জানিত কেউ?

গোরের কাফনে সাজায়ে তাহারে চলিলাম যবে বয়ে,
তুমি যে কহিলা বা-জানরে মোর কোথা যাও দাদু লয়ে?
তোমার কথার উত্তর দিতে কথা থেমে গেল মুখে,
সারা দুনিয়ার যত ভাষা আছে কেঁদে ফিরে গেল দুখে!
তোমার বাপের লাঙল-জোয়াল দুহাতে জঢ়ায়ে ধরি,
তোমার মায়ে যে কতই কাঁদিতে সারা দিনমান ভরি।
গাছের পাতার সেই বেদনায় বুনো পথে যেতো ঝরে,
ফালগুনী হাওয়া কাঁদিয়া উঠিত শুনো-মাঠখানি ভরে।

পথ দিয়া যেতে গেঁয়ো পথিকেরা মুছিয়া যাইত চোখ,
চরণে তাদের কাঁদিয়া উঠিত গাছের পাতার শোক।
আথালে দুইটি জোয়ান বলদ সারা মাঠ পানে চাহি,
হাম্বা রবেতে বুক ফাটাইত নয়নের জলে নাহি।
গলাটি তাদের জড়ায়ে ধরিয়া কাঁদিত তোমার মা,
চোখের জলের গহীন সায়রে ডুবায়ে সকল গাঁ।
ঊদাসিনী সেই পল্লী-বালার নয়নের জল বুঝি,
কবর দেশের আন্ধারে ঘরে পথ পেয়েছিল খুজি।

তাই জীবনের প্রথম বেলায় ডাকিয়া আনিল সাঁঝ,
হায় অভাগিনী আপনি পরিল মরণ-বিষের তাজ।
মরিবার কালে তোরে কাছে ডেকে কহিল, বাছারে যাই,
বড় ব্যথা র’ল, দুনিয়াতে তোর মা বলিতে কেহ নাই,
দুলাল আমার, যাদুরে আমার, লক্ষী আমার ওরে,
কত ব্যথা মোর আমি জানি বাছা ছাড়িয়া যাইতে তোরে।
ফোঁটায় ফোঁটায় দুইটি গন্ড ভিজায়ে নয়ন¬জলে,
কী জানি আশিস করে গেল তোরে মরণ¬ব্যথার ছলে।

ক্ষণপরে মোরে ডাকিয়া কহিল¬ আমার কবর গায়
স্বামীর মাথার মাথালখানিরে ঝুলাইয়া দিও বায়।
সেই যে মাথাল পচিয়া গলিয়া মিশেছে মাটির সনে,
পরাণের ব্যথা মরে নাকো সে যে কেঁদে ওঠে ক্ষণে ক্ষণে।
জোড়মানিকেরা ঘুমায়ে রয়েছে এইখানে তরু¬ছায়,
গাছের শাখারা স্নেহের মায়ায় লুটায়ে পড়েছে গায়।
জোনকি¬মেয়েরা সারারাত জাগি জ্বালাইয়া দেয় আলো,
ঝিঁঝিরা বাজায় ঘুমের নূপুর কত যেন বেসে ভালো।

হাত জোড় করে দোয়া মাঙ দাদু, রহমান খোদা! আয়,
ভেস্ত নসিব করিও আজিকে আমার বাপ ও মায়!
এখানে তোর বুজির কবর, পরীর মতন মেয়ে,
বিয়ে দিয়েছিনু কাজিদের বাড়ি বনিয়াদি ঘর পেয়ে।
এত আদরের বুজিরে তাহারা ভালবাসিত না মোটে,
হাতেতে যদিও না মারিত তারে শত যে মারিত ঠোঁটে।
খবরের পর খবর পাঠাত, দাদু যেন কাল এসে
দুদিনের তরে নিয়ে যায় মোরে বাপের বাড়ির দেশে।

শ্বশুর তাহার কশাই চামার, চাহে কি ছাড়িয়া দিতে
অনেক কহিয়া সেবার তাহারে আনিলাম এক শীতে।
সেই সোনামুখ মলিন হয়েছে ফোটে না সেথায় হাসি,
কালো দুটি চোখে রহিয়া রহিয়া অশ্রু উঠিছে ভাসি।
বাপের মায়ের কবরে বসিয়া কাঁদিয়া কাটাত দিন,
কে জানিত হায়, তাহারও পরাণে বাজিবে মরণ¬বীণ!
কী জানি পচানো জ্বরেতে ধরিল আর উঠিল না ফিরে,
এইখানে তারে কবর দিয়েছি দেখে যাও দাদু! ধীরে।

ব্যথাতুরা সেই হতভাগিনীরে বাসে নাই কেহ ভালো,
কবরে তাহার জড়ায়ে রয়েছে বুনো ঘাসগুলি কালো।
বনের ঘুঘুরা উহু উহু করি কেঁদে মরে রাতদিন,
পাতায় পাতায় কেঁপে উঠে যেন তারি বেদনার বীণ।
হাত জোড় করে দোয়া মাঙ দাদু, আয় খোদা! দয়াময়।
আমার বু¬জীর তরেতে যেন গো বেস্ত নসিব হয়।
হেথায় ঘুমায় তোর ছোট ফুপু, সাত বছরের মেয়ে,
রামধনু বুঝি নেমে এসেছিল ভেস্তের দ্বার বেয়ে।

ছোট বয়সেই মায়েরে হারায়ে কী জানি ভাবিত সদা,
অতটুকু বুকে লুকাইয়াছিল কে জানিত কত ব্যথা!
ফুলের মতন মুখখানি তার দেখিতাম যবে চেয়ে,
তোমার দাদির ছবিখানি মোর হদয়ে উঠিত ছেয়ে।
বুকেতে তাহারে জড়ায়ে ধরিয়া কেঁদে হইতাম সারা,
রঙিন সাঁঝেরে ধুয়ে মুছে দিত মোদের চোখের ধারা।
একদিন গেনু গজনার হাটে তাহারে রাখিয়া ঘরে,
ফিরে এসে দেখি সোনার প্রতিমা লুটায় পথের পরে।

সেই সোনামুখ গোলগাল হাত সকলি তেমন আছে।
কী জানি সাপের দংশন পেয়ে মা আমার চলে গেছে।
আপন হস্তে সোনার প্রতিমা কবরে দিলাম গাড়ি,
দাদু! ধর¬ধর¬ বুক ফেটে যায়, আর বুঝি নাহি পারি।
এইখানে এই কবরের পাশে আরও কাছে আয় দাদু,
কথা কস নাকো, জাগিয়া উটিবে ঘুম¬ভোলা মোর যাদু।
আস্তে আস্তে খুঁড়ে দেখ দেখি কঠিন মাটির তলে,
ওই দূর বনে সন্ধ্যা নামিয়ে ঘন আবিরের রাগে,
অমনি করিয়া লুটায়ে পড়িতে বড় সাধ আজ জাগে।

মজিদ হইতে আযান হাঁকিছে বড় সুকরুণ সুরে,
মোর জীবনের রোজকেয়ামত ভাবিতেছি কত দূরে।
জোড়হাত দাদু মোনাজাত কর, আয় খোদা! রহমান।
ভেস্ত নসিব করিও সকল মৃত্যু¬ব্যথিত প্রাণ।

এত হাসি কোথায় পেলে

জসীমউদ্দীন

এত হাসি কোথায় পেলে
এত কথার খলখলানি
কে দিয়েছে মুখটি ভরে
কোন বা গাঙের কলকলানি।
কে দিয়েছে রঙিন ঠোঁটে
কলমী ফুলের গুলগুলানি।
কে দিয়েছে চলন বলন
কোন সে লতার দোল দুলানী।

কাদের ঘরে রঙিন পুতুল
আদরে যে টইটুবানি।
কে এনেছে বরণ ডালায়
পাটের বনের বউটুবানী।
কাদের পাড়ার ঝামুর ঝুমুর
কাদের আদর গড়গড়ানি
কাদের দেশের কোন সে চাঁদের
জোছনা ফিনিক ফুল ছড়ানি।

তোমায় আদর করতে আমার
মন যে হলো উড়উড়ানি
উড়ে গেলাম সুরে পেলাম
ছড়ার গড়ার গড়গড়ানি।

নিমন্ত্রণ

জসীমউদ্দীন

তুমি যাবে ভাই – যাবে মোর সাথে, আমাদের ছোট গাঁয়,
গাছের ছায়ায় লতায় পাতায় উদাসী বনের বায়।
মায়া মমতায় জড়াজড়ি করি
মোর গেহখানি রহিয়াছে ভরি,
মায়ের বুকেতে, বোনের আদরে, ভাইয়ের স্নেহের ছায়,
তুমি যাবে ভাই – যাবে মোর সাথে, আমাদের ছোট গাঁয়,

ছোট গাঁওখানি – ছোট নদী চলে, তারি একপাশ দিয়া,
কালো জল তার মাজিয়াছে কেবা কাকের চক্ষু নিয়া।
ঘাটের কিনারে আছে বাঁধা তরী
পারের খবর টানাটানি করি।
বিনাসুতি মালা গাথিছে নিতুই এপার ওপার দিয়া।
বাঁকা ফাঁদ পেতে টানিয়া আনিছে দুইটি তটের হিয়া।

তুমি যাবে ভাই – যাবে মোর সাথে, ছোট সে কাজল গাঁয়,
গলাগলি ধরি কলা বন; যেন ঘিরিয়া রয়েছে তায়।
সরু পথ খানি সুতায় বাঁধিয়া
দূর পথিকেরে আনিছে টানিয়া,
বনের হাওয়ায়, গাছের ছায়ায়, ধরিয়া রাখিবে তায়,
বুকখানি তার ভরে দেবে বুঝি, মায়া আর মমতায়!

তুমি যাবে ভাই যাবে মোর সাথে – নরম ঘাসের পাতে
চম্বন রাখি অধরখানিতে মেজে লয়ো নিরালাতে।
তেলাকুচা-লতা গলায় পরিয়া
মেঠো ফুলে নিও আঁচল ভরিয়া,
হেথায় সেথায় ভাব করো তুমি বুনো পাখিদের সাথে,
তোমার গায়ের রংখানি তুমি দেখিবে তাদের পাতে।

তুমি যদি যাও আমাদের গাঁয়ে, তোমারে সঙ্গে করি
নদীর ওপারে চলে যাই তবে লইয়া ঘাটের তরী।
মাঠের যত না রাখাল ডাকিয়া
তোর সনে দেই মিতালী করিয়া
ঢেলা কুড়িইয়া গড়ি ইমারত সারা দিনমান ধরি,
সত্যিকারের নগর ভুলিয়া নকল নগর গড়ি।

তুমি যদি যাও – দেখিবে সেখানে মটর লতার সনে,
সীম আর সীম – হাত বাড়াইলে মুঠি ভরে সেই খানে।
তুমি যদি যাও সে – সব কুড়ায়ে
নাড়ার আগুনে পোড়ায়ে পোড়ায়ে,
খাব আর যত গেঁঢো – চাষীদের ডাকিয়া নিমন্ত্রণে,
হাসিয়া হাসিয়া মুঠি মুঠি তাহা বিলাইব দুইজনে।

তুমি যদি যাও – শালুক কুড়ায়ে, খুব – খুব বড় করে,
এমন একটি গাঁথিব মালা যা দেখনি কাহারো করে,
কারেও দেব না, তুমি যদি চাও
আচ্ছা না হয় দিয়ে দেব তাও,
মালাটিরে তুমি রাখিও কিন্তু শক্ত করিয়া ধরে,
ও পাড়াব সব দুষ্ট ছেলেরা নিতে পারে জোর করে।

সন্ধ্যা হইলে ঘরে ফিরে যাব, মা যদি বকিতে চায়,
মতলব কিছু আঁটিব যাহাতে খুশী তারে করা যায়!
লাল আলোয়ানে ঘুঁটে কুড়াইয়া
বেঁধে নিয়ে যাব মাথায় করিয়া
এত ঘুষ পেয়ে যদি বা তাহার মন না উঠিতে চায়,
বলিব – কালিকে মটরের শাক এনে দেব বহু তায়।

খুব ভোর ক’রে উঠিতে হইবে, সূয্যি উঠারও আগে,
কারেও ক’বি না, দেখিস্ পায়ের শব্দে কেহ না জাগে
রেল সড়কের ছোট খাদ ভরে
ডানকিনে মাছ কিলবিল করে।
কাদার বাঁধন গাঁথি মাঝামাঝি জল সেঁচে আগে ভাগে
সব মাছগুলো কুড়ায়ে আনিব কাহারো জানার আগে।

ভর দুপুরেতে এক রাশ কাঁদা আর এক রাশ মাছ,
কাপড়ে জড়ায়ে ফিরিয়া আসিব আপন বাড়ির কাছ।
ওরে মুখ-পোড়া ওরে রে বাঁদর।
গালি-ভরা মার অমনি আদর,
কতদিন আমি শুনি নারে ভাই আমার মায়ের পাছ।
যাবি তুই ভাই, আমাদের গাঁয়ে যেথা ঘন কালো গাছ।

যাবি তুই ভাই, যাবি মোর সাথে আমাদের ছোট গাঁয়।
ঘন কালো বন – মায়া মমতায় বেঁধেছে বনের বায়।
গাছের ছায়ায় বনের লতায়
মোর শিশুকাল লুকায়েছে হায়!
আজি সে-সব সরায়ে সরায়ে খুজিয়া লইব তায়,
যাবি তুই ভাই, যাবি মোর সাথে আমাদের ছোট গায়।

তোরে নিয়ে যাব আমাদের গাঁয়ে ঘন-পল্লব তলে
লুকায়ে থাকিস্, খুজে যেন কেহ পায় না কোনই বলে।
মেঠো কোন ফুল কুড়াইতে যেয়ে,
হারাইয়া যাস্ পথ নাহি পেয়ে।
অলস দেহটি মাটিতে বিছায়ে ঘুমাস সন্ধ্যা হলে,
সারা গাঁও আমি খুজিয়া ফিরিব তোরি নাম বলে বলে।

প্রতিদান

জসীম উদ্দীন

আমার এ ঘর ভাঙিয়াছে যেবা আমি বাঁধি তার ঘর,
আপন করিতে কাঁদিয়া বেড়াই যে মোরে করেছে পর।
যে মোরে করিল পথের বিবাগী-
পথে পথে আমি ফিরি তার লাগি,
দিঘল রজনী তার তরে জাগি ঘুম যে হরেছে মোর।

আমার এ ঘর ভাঙিয়াছে যেবা আমি বাঁধি তার ঘর।
আমার এ কূল ভাঙিয়াছে যেবা আমি তার কূল বাঁধি,
যে গেছে বুকে আঘাত হানিয়া তার লাগি আমি কাঁদি।
যে মোরে দিয়েছে বিষে-ভরা বাণ,
আমি দেই তারে বুকভরা গান,
কাঁটা পেয়ে তারে ফুল করি দান সারাটি জনম-ভর,
আপন করিতে কাঁদিয়া বেড়াই যে মোরে করেছে পর।

মোর বুকে যেবা কবর বেঁধেছে আমি তার বুক ভরি
রঙিন ফুলের সোহাগ-জড়ানো ফুল মালঞ্চ ধরি।
যে মুখে সে কহে নিঠুরিয়া বাণী,
আমি লয়ে সখি তারই মুখখানি,
কত ঠাঁই হতে কত কীযে আনি সাজাই নিরন্তর-
আপন করিতে কাঁদিয়া বেড়াই যে মোরে করেছে পর।

আমাদের সুন্দর সুন্দর আরও পোষ্ট পড়তে:

মায়া নিয়ে উক্তি, স্ট্যাটাস, ক্যাপশন, কিছু কথা ও কবিতা

দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে উক্তি, স্ট্যাটাস, ক্যাপশন, কবিতা ও কিছু কথা

ভ্রমন নিয়ে স্ট্যাটাস, উক্তি, ক্যাপশন ও কিছু কথা

নীরবতা নিয়ে স্ট্যাটাস, উক্তি ও ক্যাপশন

সফলতা নিয়ে উক্তি, স্ট্যাটাস, ক্যাপশন ও গল্প

মানসিক চাপ নিয়ে উক্তি, স্ট্যাটাস, ক্যাপশন, কবিতা ও কিছু কথা

সমালোচনা নিয়ে উক্তি, স্ট্যাটাস, কবিতা, ক্যাপশন ও কিছু কথা

মুখোশধারী মানুষ নিয়ে উক্তি, স্ট্যাটাস, ক্যাপশন ও কবিতা

হতাশা নিয়ে উক্তি, ইসলামিক উক্তি, স্ট্যাটাস, ক্যাপশন ও কবিতা

শেষ কথা

জসীম উদ্দীন এর উক্তি ও কবিতা নামক পোষ্টটি আপনাদের কেমন লাগলো? আশা করি আপনাদের অনেক ভালো লেগেছে। যদি আপনাদের ভালো লেগে থাকে তাহলে আমাদের লেখা স্বার্থ হয়।
এতক্ষণ কষ্ঠ করে পোষ্টটি পড়ার জন্য আপনাকে জানাই আমাদের পক্ষ থেকে ধন্যবাদ। আল্লাহ আপনার সবর্দা মঙ্গল করুক। আমীন।

About Durud Ahmed

সম্মানিত ভিজিটর আমি দুরুদ আহমেদ,পেশায় আমি একজন ব্লগ লেখক। প্রযুক্তি ও শিক্ষা, ইতিহাস-ঐতিহ্য, লাইফস্টাইল এবং ইসলামিক লেখাই আমার প্রিয়। এই ব্লগের মাধ্যমে আমি সঠিক তথ্য প্রদানের মাধ্যমে ভিজিটরদের সহযোগিতা করাই মূল লক্ষ্য।